জুয়েল রাজঃ
আগামী ৫মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেট নির্বাচন, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ২০১০ সালের নির্বাচনে ভোট দেয়ার এবং বাঙালির জয়যাত্রার ইতিহাসের স্বাক্ষী হওয়ার। সেদিন লুৎফুর রহমান মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৪ সালে লুতফুর রহমান টাওয়ার হ্যামলেটের মেয়র নির্বাচিত হন। সেই ইতিহাসের ও অংশ হতে পেরেছিলাম।
কিন্ত দূর্ভাগ্য লন্ডনের বাঙালিদের দূর্ভাগ্য লুতফুর রহমানের। সব ইতিহাস ম্লান করে দিয়ে তিনি উজ্জ্বল ইতিহাসে এক কালো দাগ টেনে দিলেন।
প্রচলিত একটা কথা আছে মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। লুতফুর রহমান ও নিশ্চয় তাঁর স্বপ্নের সমানই বড়, তাইতো বারবার চেষ্টা করেছেন তাঁর হারানো মসনদ ফিরে পেতে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী করেছিলেন রাবিনা খান কে। সেখানে ব্যার্থ হয়েছেন, ২০১৮ সালে আবার চেষ্টা করেছিলেন অহিদ আহামেদ কে দিয়ে। কিন্ত সফল হতে পারেন নি। আইনী ঝামেলা শেষে এবার তাই নিজেই মাঠে নেমেছেন হারানো রাজ্য উদ্ধারে। 

একটু পিছনে ফিরে দেখলে, আইনী লড়াইয়ে, লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের পুলিশ কোন ধরণের ফৌজদারী অপরাধ বা Criminal Offence পায় নাই বলে তাঁর কোন জেল দন্ড হয় নাই।
কিন্ত Civil Offence বা আইনের ভাষায় দেওয়ানী অপরাধ পেয়েছিল । নির্বাচন প্রভাবিত করার এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করার কারণে তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল।
এখন নির্বাচনী ডামাডোলে ভোটারদের কাছে যেভাবেই তাঁকে নির্দোষ বলে গলা ফাটাই না কেন সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন লুতফুর রহমান আদালত কতৃক সাজাপ্রাপ্ত। একবারে সহজ কথায় যদি বলি, লুতফুর রহমান যদি নির্দোষ হন, তাহলে মেয়রের ক্ষমতা ফেরত পাওয়ার কথা ছিল। তাঁর সলিসিটর লাইসেন্স ফেরত পাওয়ার কথা ছিল। বা যাবতীয় মানহানীর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা ছিল। ব্রিটেনের আইনে সেটাই সাধারণ নিয়ম। যেহেতু আইনী ভাবে তাঁকে সরানো হয়েছিল, তাই আইনী ভাবেই ক্ষতি পূরণ পাওয়ার অধিকার রাখেন যে কোন নাগরিক।
এর কোনটাই তাঁর ক্ষেত্রে হয়নি বরং নির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে তাঁকে দুই নির্বাচন পরে এইবারের নির্বাচনে অংশ নিতে হচ্ছে। 

২০১৮ সালে মেয়র নির্বাচন পরে সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকায় লিখেছিলাম ” নির্দোষ লুতফুর রহমান বিশুদ্ধ হতে পারবেন কি? “
আমার সেই লেখাটি কাকতালীয় ভাবে ৪ বছর পরে এসে পুরোই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
একজন বাঙালি হিসাবে আমি মনে প্রাণে চাই আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে নেতৃত্ব আসুক। লুতফুর রহমানের উত্থান কালীন সময়ে তাই মনে প্রাণে তাঁকে সমর্থন দিয়েছি। কিন্ত যে সমস্ত অভিযোগে তাঁকে অপসারণ করা হয়েছে, নৈতিক ভাবে সে সব সমর্থন করার কোন উপায় নাই। ব্রিটেনের বর্তমান কনজার্ভেটিভ সরকারে ভারত পাকিস্থানের বেশ কয়েকজন দায়িত্ব প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আছেন।কিন্ত সেখানে বাঙালি কেউ নেই। আমাদের চার জন সংসদ সদস্য আছেন, লেবার পার্টি যদি কখনো সরকার গঠন করে,এবং ব্রিটিশ বাংলাদেশি সংসদ সদস্যগণ যদি নির্বাচিত হন হয়তো আমরা বাঙালি মন্ত্রী পেতে ও পারি। লেবার পার্টির নেতা নির্বাচনে রোশনারা আলী একবার অনেক দূর হেঁটেছিলেন। সেই সুদিন যদি কখনো আসে ব্রিটেনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আমরা হয়তো সেদিন কোন বাঙালিকে দেখতে পাবো।
টাওয়ার হ্যামলেট নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতির এই প্রসঙ্গের অবতারণার কারণ। লুতফুর রহমানকে নিয়ে ও এক সময় আকাশ সমান প্রত্যাশা ছিল। শুধু আমি না, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বাসিন্দাগণ না, পুরো যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষ গর্ব করতেন।
কিন্ত সেই গৌরব তিনি ধরে রাখতে পারেন নি। টাওয়ার হ্যামলেট লেবার পার্টির সাবেক সদস্য লুৎফর রহমান ২০১০ সালে দল থেকে মেয়র পদে দাঁড়ানোর জন্য মনোনীত হয়েছিলেন । কিন্তু ইসলামপন্থি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ওই নির্বাচনে অংশ নেন তিনি। ২০১০ সালের ওই নির্বাচনে ব্রিটেনের ইতিহাসে প্রথম সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে, মেয়র হিসেবে বিপুল ভোটে হয়েছিলেন তিনি। এবং সেটি বাঙালিদের এক তরফা ভোটের কারণেই সম্ভব হয়েছিল ।
পরবর্তীকালে যদিও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল , তাকে সমর্থন দেওয়ার জন্য জনগণকে কাউন্সিল হাউজে তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন। এ ছাড়া মুসলিম ভোটারদের ‘ভালো মুসলিম’ হিসেবে পরিচিতির কথা বলে তাকে সমর্থন করতে বলা হয়। ভোটের সময় তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে ব্যালট পেপার জালিয়াতি, পোস্টাল ভোটকে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগানো ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোট সরঞ্জামের ক্ষতি সাধনের অভিযোগ তোলা হয়েছিল । এ ছাড়া তার চার সমর্থকের বিরুদ্ধে হাইকোর্টের দলিল-পত্র নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়েছিল । পূর্ব লন্ডনের একটি আদালতে স্থানীয় বাসিন্দা অ্যান্ড্রু এরলাম, দেব্বি সিমন, আজমল হোসাইন ও অ্যাঞ্জেলা মোফাট এসব অভিযোগে পিটিশনটি দায়ের করেছিলেন।
নির্বাচন কমিশনার রিচার্ড ম্যারে জানিয়েছিলেন , লুতফুরের বিরুদ্ধে নির্বাচনে দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা ও ধর্মকে অবৈধভাবে ব্যবহারের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। এবং ২০১৪ সালে নির্বাচনে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। এর পরের ইতিহাস সবার জানা।
২০১৫ সালে একটি আদালতে, নির্বাচনে দুর্নীতি ও অবৈধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় লুৎফর রহমানকে বহিষ্কার করা হয়। এবং অভিযোগের বিষয়ে সরকারের পক্ষে কাজ করা আইনজীবীদের অর্থ বাবদ তাকে ৫ লাখ পাউন্ড অর্থ পরিশোধ করতে বলা হয়। তখন নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পাঁচ লাখ পাউন্ড দিতে না পেরে লুৎফর রহমান নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন। এ পরিস্থিতিতে তাঁর ‘ব্রোমলি-বাই-বো’ এর বাড়িটি নিলামে করে দেনা মিটাতে হয়েছিল । করসহ যাবতীয় আনুষঙ্গিক খরচ মেটানোর পর বাড়িটির দাম ধরা হয়েছে আড়াই লাখ পাউন্ড।
তবে লুৎফুর রহমান সবসময় নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। শুরু থেকেই ব্যক্তি ও মহল বিশেষের প্রতিহিংসার শিকার বলে দাবি করেন। তাঁর আইন পেশার লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল। সহজ কথায় তাঁর দীর্ঘ জীবনের অর্জন টেমসের পানিতে ভেসে গিয়েছিল।
এই লুতফুর রহমান যখন আবার আমদের নেতা হতে ফিরে আসলেন, তাঁকে নৈতিকতার পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। তিনি কতোটা নির্দোষ, আর কতোটা অপরাধী। নির্বাচনী প্রচারণায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, পক্ষে বিপক্ষে, নির্দোষ না অপরাধী এইসব নিয়ে নানা রকম লেখালেখি, প্রচারণা চলছে। এই সব দেখে, রামায়ণের সীতার অগ্নিপরীক্ষার কাহিনী মনে পড়লো। রাম জানতেন সীতা নির্দোষ, কিন্ত রাজ্যের জনগণের কথা ছিল, যেহেতু সীতা রাবণের হাতে দীর্ঘদিন বন্দী ছিলেন, তাই তাঁর সতীত্ব নিয়ে তারা সন্দিহান। রাম তাই জেনে বুঝে ও শুধুমাত্র রাজ্যের জনগণের ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নিজের প্রিয় স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ করেছিলেন। সীতা সেই অপমানে ক্ষোভে, ইশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন মাটি দুভাগ হওয়ার জন্য। ইশ্বর মাটি কে দুভাগ করে দেন এবং পাতালবাসিনী হয়েছিলেন।
সেই রাম ও নাই সেই অযোধ্যা ও নাই, আমাদের আছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। এখানেই লুতফুর রহমান কে প্রমাণ করতে হবে তিনি কতোটা সৎ কিংবা কতোটা অসৎ। ২০১৮ সালের আমার লেখায় আমি বলেছিলাম,
স্বীকার করুন কিংবা না করুন টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের নির্বাচনে, ধর্মকে বা ধর্মীয় রাজনীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। টাওয়ার হ্যামলেট কাউন্সিলের ৩২ শতাংশ বাঙালি ভোটার আছেন। যাদের প্রায় সকলেই মুসলমান ভোটার। কিন্তু লুতফুর রহমানের সমর্থিত প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াত ইসলামের সাথে সম্পর্কিত নেতৃবৃন্দই তখন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। যার কারণে প্রগতিশীল অংশটি সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । সর্বশেষ নির্বাচনে তাঁর সমর্থিত কাউন্সিল প্রার্থীদের যে ভরাডুবি হয়েছে তা ছিল কল্পনাতীত। অনেক প্রতিভাবান তরুণের ও ভরাডুবি হয়েছে সেখানে। যাদের মূল ধারার রাজনীতিতে উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিল।২০২২ সালের নির্বাচনে লুতফুর রহমান হয়তো আবার অংশ নিতে পারবেন। কিন্তু ২০১০ সালের বাঙালি প্রার্থী হিসাবে তাঁর যে অবস্থান ছিল , সেই অবস্থান থেকে আদালত তাঁকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। আমার সেই লেখা সত্যি হয়েছে, লুতফুর রহমান নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবী করছেন কিন্ত বাস্তবতা হলো, তাঁকে নিষেধাজ্ঞা বা আদালতের সাজা কাটিয়ে দীর্ঘ ৭ বছর পর মাঠে নামতে হয়েছে। তিনি বিশুদ্ধ হতে পারেন নি।
ব্রিটিশ বাঙালিদের মাঝে দুইটি ধারা বহমান একটি ইসলামী ধারা একটি প্রগতিশীল ধারা। এই দুই ধারা কখনো এক হবেনা। সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকলে ও রাজনৈতিক কিংবা কোন পদ পদবীর হিসাব নিকাষে তাঁরা ঠিক ঠিক নিজ আদর্শিক জায়গায় অবস্থান নিয়ে নেন। সেই হিসাবে একতাবদ্ধ কমিউনিটি হওয়ার সুযোগ বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির খুবই কম। বাঙালি আত্মপরিচয়ে এই বিভক্তি কিছুটা ঘুচানো হয়তো সম্ভব ছিল। কিন্তু জামায়াত সমর্থিত কিংবা ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ লুতফুর রহমানের সুসময় দুঃসময়ে তাঁর পাশে ছিলেন সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। লুতফুর রহমান তাঁর দুঃসময়ের সাথীদের ফেলে আসার পথ খোলা আছে বলে মনে হয় না। সব চেয়ে লক্ষনীয় বিষয় হলো এবারের নির্বাচনে লুতফুর রহমান তাঁর নতুন রাজনৈতিক দলে একজন অবাঙালি প্রার্থীকেও নমিনেশন দিতে পারেন নাই। যেখানে মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ বাঙালি সেখানে ১০০ভাগ কাউন্সিলর প্রার্থী দিয়েছেন ৩০ শতাংশের ভিতর থেকে। এই ব্যাপারটি লন্ডনের বহু বর্ণের সমাজে কতটুকো প্রভাব ফেলবে সেটিও ভাবার বিষয়। এই অবস্থায়, তিনি বিশুদ্ধ হয়ে আবারও কমিউনিটির নেতা হতে পারবেন কী না সেটা সময়ই বলে দিবে।
একটা উদাহরণ দিলে নির্দোষ ও বিশুদ্ধতার বিষয়টা হয়তো কিছুটা পরিস্কার হবে। ভারতের গঙা নদীর পানি খুবই নোংরা এবং বলা হয়ে থাকে বিষাক্ত। কিন্ত এই গঙাজল সেদেশের মানুষের কাছে পবিত্রতার প্রতীক। ব্রিটেনের বাঙালি সমাজ ও সেই পবিত্র ও বিশুদ্ধ নেতাই চায় । যাকে নিয়ে আমরা মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারি। গর্ব করতে পারি। যারা শুধু টাওয়ার হ্যামিলেটস নয় পুরো ব্রিটেনকে নেতৃত্ব দিবেন সেই দিনের স্বপ্ন দেখি।
আমার এই ব্যাক্তি ইচ্ছা বা ব্যাক্তি মতের প্রতি অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, ভাল হউক মন্দ হউক তিনি বাঙালি। আমি সেই মতবাদে বিশ্বাসী নই। আমি চাই আমার যিনি নেতা হবেন তিনি আদর্শিক হবেন। যাকে আমি বা আমার পরবর্তী প্রজন্ম আইডল হিসাবে মানবে। সেই আদর্শিক বাঙালি নেতার অপেক্ষায় থাকব। সেই পবিত্র নেতা আমাদের সৃষ্টি করতে হবে। ব্রিটেনের বাঙালি নতুন প্রজন্ম যে ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেই দিন খুব বেশী দূরে নয়।
লেখকঃ সম্পাদক ব্রিকলেন