আজ ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৫, সকাল ৬:৪০

এক চরম দানবীয় হত্যাকান্ড, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ!

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শৈলেন কুমার দাশ-

গত বৃহস্পতিবার, ১৮ই ডিসেম্বর ২০২৫, ময়মনসিংহের ভালুকায় পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস এর সুপারভাইজার দীপু দাসকে ইসলাম ধর্ম অবমাননার মিথ্যা অভিযোগ তৈরি করে তৌহিদী জনতা প্রকাশ্যে বেধড়ক পিটিয়ে অর্ধ-মৃত করে এবং এরপর মহাসড়কের পাশে একটি গাছে ঝুলিয়ে আগুন দিয়ে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করে। ইতোমধ্যে Rapid Action Batilion (RAB) সত্য তথ্য প্রকাশ করেছে “দীপু দাস ইসলাম ধর্ম অবমাননা করে কোন বক্তব্য দেয়নি!” নিরীহ দরিদ্র পরিবারের মেধাবী ছেলে দীপু দাস! বাংলাদেশের ময়মনসিংহের, ভালুকার অতি সাধারণ পরিবারের নিরীহ ভদ্র ছেলে এই দীপু দাস। সে ভালুকার পাইনিয়ার নিটওয়্যারস এর একজন সুপারভাইজার হিসাবে কর্মরত ছিল। সাধারণ পরিবারের অত্যন্ত ভদ্র ছেলে যে নিজের মেধা, কর্মদক্ষতা ও দায়িত্ব পরায়নাতার কারণে সম্প্রতি সাধারণ কর্মী থেকে সুপারভাইজার পদে উন্নীত হয়। তাঁর এই পদোন্নতি কয়েকজন মুসলিম সহকর্মী মেনে নিতে পারেনি। ঐ লোকেরা ঘুষ দিয়ে এই সুপারভাইজার পজিসনটি বাগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে দীপু দাসের বিরুদ্ধে মিথ্যা, বানোয়াট ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ সাজিয়ে সন্ত্রাসী মব সৃষ্টি করে নির্মম, পৈচাশিকভাবে মারপিট করে অর্ধমৃত অবস্হায় উলঙ্গ করে গাছে ঝুলিয়ে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে!

গত বৃহস্পতিবার ১৮ই ডিসেম্বর রাত নয়টায়, রাতের আকাশ স্তব্ধ হয়ে যায় এই অতি দানবীয় জঘন্য্য কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করে। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতা, মানবতা, হাজার বছরের বাংলার পারস্পরিক সম্প্রীতিকে মুহূর্তেই ধ্বংস করে দেয় কিছু নরপিচাশ দানব। শুধু তাই নয়, এই দানবেরা তাদের দানবীয় হত্যাকান্ড পরিচালনার সময় উল্লাসে মেথে উঠে! উচ্ছাস ও আনন্দ প্রকাশ করে! ভাবতে অবাক লাগে “এরা কি আসলে কোন মায়ের সন্তান?” আমার মন বিস্ময়ে দুমড়ে মুচড়ে যায় এটা ভেবে যে, “এরা কি মানুষ না পশু?” একই বিস্ময় আর কষ্টের বুক ফাটা বেদনা প্রকাশ পেয়েছে প্রিয়জন, সালেহা আশরাফ (কান্তা) এর কণ্ঠে! ষোল কোটি বাংলাদেশীদের মধ্যে অন্ততঃ একজন সালেহা আশরাফ হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছেন নিরীহ দীপু দাসের মানবিক ইতিহাস গর্হিত নির্মম ও পাশবিক হত্যাকাণ্ডের। এই অনুভবটিও কম নয় আজকের বাংলাদেশের অমানবিক সমাজে? তিনি এই “দানবীয় উল্লাসে মেতে উঠা দানবগুলোর উপযুক্ত শাস্তি চেয়েছেন!” তিনি আরও বলেছেন, “মনুষ্যত্বহীন এই সমাজ আমাদের কারো কাম্য নয়!” উল্লেখ্য যে, রেপিড এ্যাকশন বেটেলিয়ান (RAB) তদন্ত করে প্রকাশ করেছে “নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার দীপু দাস ইসলাম ধর্ম অবমাননাকর কোন কিছুই বলেননি। এটি ছিল তাঁর বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।”

বিবিসি বাংলা ১৮ই ডিসেম্বর ২০২৫ এ প্রতিবেদনটি প্রকাশে সতর্কতা দিয়ে বলেছে, এটি মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। এতে বলা হয়েছে, ধর্ম অবমাননার অভিযোগে ময়মনসিংহে এক যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সাথে আরো বলা হয়েছে, ওই যুবকের মরদেহ গাছের সাথে বেঁধে আগুন দেয়া হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। ভালুকা থানার ডিউটি কর্মকর্তা মি. মিয়া বলেছেন, “দীপু দাস ইসলামের নবীকে কটূক্তি করেছিল।” কিন্তু এই কর্মকতর্তার বক্তব্য ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। দীপু দাসের বিরুদ্ধে তাঁর কতিপয় মুসলিম সহকর্মী যখন মব সৃষ্টির জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় দীপু দাসের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রচার করতে থাকে তখন কারখানার ফ্লোর ম্যানেজার পুলিশ কল করে দীপুকে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। দীপু তখন পুলিশ এর কাছে বার বার বলেছে তাঁর বিরুদ্ধে সব অভিযোগ মিথ্যা। সে ইসলাম ধর্ম অবমাননাকর একটি শব্দও বলেনি। সে বাটন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। তাঁর কোন স্মার্ট ফোন নেই। সে সোশ্যাল মিডিয়াও ব্যবহার করে না। সে পুলিশের কাছে বার বার জীবন ভিক্ষা চেয়েছে। উপস্থিত পুলিশের মধ্যেও দুইজন সদস্য ছিল ইসলামিক মৌলবাদী চিন্তার। এই পুলিশ সদস্যরা ইচ্ছা করেই তাদের মৌলবাদী চিন্তা থেকে হিন্দু কম্যুনিটির সদস্য দীপু দাসের হাজারো অনুনয় বিনয় ও জীবন ভিক্ষার করুণ আবেদনে কোন কর্ণপাত না করে স্বগর্বে ইসলামী মব সন্ত্রাসীদের হাতে তাঁকে তোলে দেয়।

দেশে বিদেশে সোশ্যাল মিডিয়ার হাজারো পোস্টে এই হৃদয় বিদারক ও অতি জঘন্য হত্যাকান্ডের খবর প্রকাশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এই নির্মম হত্যাকান্ডে বিশ্বব্যাপী মানবিক সজ্জন মানুষজন স্তম্ভিত ও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন! অথচ সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত এর ভিডিও এবং ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সন্ত্রাসী মব উল্লাস প্রকাশ করছে, ভিডিও তোলছে, ছবি তোলছে এবং ‘আল্লাহু-আকবার’ ধ্বনি দিচ্ছে। এমন বীভৎস দৃশ্যে যাঁরা উল্লাস করতে পারে, এ দেশেরই অনেক মায়েরা বলছেন এরা কি কোন মায়ের সন্তান? ‘হিন্দু নিউজ’ নামে একটি নিউজ পোর্টাল একই খবর বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করেছে। প্রায় সব সোশ্যাল মিডিয়ায় বলা হয়েছে, দীপু দাসকে পিটিয়ে আধমরা করে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। বিবিসি ও হিন্দু নিউজ বলেছে হত্যার পর দীপুকে পোড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশের বড় বড় মিডিয়া খবরটি প্রকাশই করেনি। নবী ও ইসলামের অবমাননার অজুহাত ও বানোয়াট কাহিনীতে বাংলাদেশে হিন্দু কম্যুনিটি সদস্যদের জীবন অতিষ্ঠ করে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েক শত হিন্দু যুবক-যুবতী এ ধরনের মিথ্যা অভিযোগে বিনা বিচারে জেলে রয়েছেন।

নিমর্মভাবে হত্যার শিকার দীপু দাসের এক মুসলিম নারী সহকর্মী বলেন, দীপুর সুপারভাইজার হিসাবে দায়িত্ব পালন অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। ইসলাম ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে ফ্লোর ম্যানেজার তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করে। তাঁকে কোন কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়নি। সে অসহায়ের মত দাঁড়িয়েছিল। আমি তখন তাঁর করুণ চেহারা দেখেছি কিন্তু আমার পক্ষে কিছুই করার ছিল না। শুধু নীরবথ কেঁদেছি। তারপর ফ্লোর ম্যানেজার তাঁকে পুলিশের হাতে দেয়। পুলিশ তাঁর কোন নিরাপত্তার ব্যবস্হা না করে তাঁকে সন্ত্রাসী মবের হাতে তোলে দিলে সন্ত্রাসীরা তাঁকে মারতে মারতে গাছে ঝুলিয়ে তাঁর শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি আরও বলেন একটি লোকও তাঁকে রক্ষা করার কোন চেষ্টা করেনি। মনে হচ্ছে পুরো দেশটিই সন্ত্রাসী হয়ে গেছে!

দীপু দাসের প্রতিবেশী মাদ্রাসায় পড়া এক দশ/বার বছরের কিশোর মো: অলি উল্লা বলে, “দীপু দাস একজন ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি তাকে সব সময় ‘মুন্সী’ বলে সম্বোধন করে মাদ্রাসায় শিখা বিভিন্ন ‘সুরা’ শুনতে চাইতেন। ইসলামের প্রতি তাঁর সম্মান ছিল অনেক। আমার বাবা মাকে অনেক সম্মান করতেন। আমার বাবাকে দেখলে সে সম্মান করে মাথা নীচু করে চলে যেতো। সে একজন ভাল মানুষ ছিল। কারো সাথে তাঁর কোন খারাপ সম্পর্ক ছিল না। এই কিশোর আরও বলে, দীপু দাসকে ষড়যন্ত্র করে এভাবে ফাঁসানো হয়েছে।”

কিছুদিন পূর্বে এই একই অভিযোগে বাংলা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উৎসব মন্ডল নামে এক যুবককে প্রায় একই ভাবে পুলিশের নিকট থেকে তিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার কোন বিচার হয়নি বলেই মব সন্ত্রাসীরা দেশব্যাপী এমন তান্ডব করার সাহস পাচ্ছে।

ধর্ম অবমাননার অভিযোগে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর আক্রমন, ব্যবসা ও বাড়িঘর লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এখন নিত্যদিনের ঘটনা। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ একমাত্র ২০২৪ সালেই দেশে হিন্দুদের উপর এমন নির্যাতন ঘটে ২০০০ টির উপরে। আর ২০২৫ সালে বিখ্যাত নোবল লরিয়েট মেটিকুলাস ডিজাইন এর মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর এ ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ৫০০০ এর উপরে ইতোমধ্যে সংগঠিত হয়েছে হিন্দু কম্যুনিটির সদস্যদের উপরে। এবং প্রতিনিয়ত ঘটেই চলছে। প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। সেদিকে শান্তির নোবেল লরিয়েটের কোন ভ্রূক্ষেপই নেই। দেশের সর্বস্তরের সিংহভাগ মানুষ বলতে শুরু করেছে “এমন একজন পাষাণ মানুষ যার প্রতিটি পদক্ষেপ ছলনায় সাজানো সে কি করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পায়? অশান্তির হুতা ও মানুষ হত্যাকারী নীরব প্রশাসনের এই প্রধানের নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নেয়া হোক।”

বাংলাদেশে ‘ব্লাসফেমি’ আইন কাযর্যকর নেই সত্য কিন্তু সাইবার সিকিউরিটি এক্ট (সিএসএ) এর অপপ্রয়োগের মাধ্যমে বর্তমান ইনটেরিম সরকার হিন্দুদের ওপর ধর্মীয় অবমাননার মামলা দায়ের করে নানাভাবে হিন্দুদের জীবন জীবিকা অতিষ্ঠ করে তোলেছে। এই সরকারের মূল উদ্দেশ্যে হচ্ছে যোগ্য ও মানব সম্পদ হিন্দুদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দিয়ে তাঁদেরকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দেয়া। যাতে হিন্দুরা ক্রমাগত অশান্তির মধ্যে থেকে দেশ জেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের অবমাননার অভিযোগ ওঠে এবং যার ৯৯ শতাংশই দীপু দাসের ঘটনার মত মিথ্যা ও সাজানো। এখন দেশে হিন্দুরা এই ‘সিএসএ’ এর আধীনে প্রতিনিয়ত মিথ্যা অভিযোগে শাস্তি পাচ্ছে। অথচ মুসলিম হুজুরেরা প্রতিনিয়ত হিন্দু ধর্মের অবমাননা করে প্রকাশ্যে ওয়াজ মাহফিলে, আলোচনায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায়। এর কিন্তু কোন বিচার হয় না এবং কেউ মামলাও করতে পারে না? ক’দিন আগে বিএনপি নেতা হারুনুর রশিদ তার নির্বাচনী ভাষণে অতি অসম্মানের সাথে বলেছেন, ‘হিন্দুরা শয়তানের পূজা করে’। তার বিরুদ্ধে মামলা নেয়া হয়নি। বরঞ্চ তিনি তার দলের দ্বারা পুরস্কৃত হয়েছেন। আগামী নিবর্বাচনে বিএনপি’র মনোনয়ন পেয়েছেন।

বাংলাদেশে হিন্দুরা এখন চরম এক অসহায় পরিস্হিতির মধ্যে বসবাস করছে। প্রতিনিয়ত তাঁদের ভয়ের মধ্যে দিনযাপন করতে হচ্ছে। সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতা কেউ তাদের পাশে নেই। মৌলবাদী-জঙ্গি গোষ্ঠী নাবালিকা কন্যা অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, চাঁদাবাজি, জমি, ব্যবসা, বাড়ীঘর লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে অবিরামভাবে। দেখার কেউ নেই! এ অবস্থায় চরম সংকটাপন্ন এই বাংলাদেশের সজ্জন, সুন্দর হিন্দুরা যারা সন্ত্রাস জানে না ; জঙ্গিপনা জানে না। সেই হিন্দুদের পাশে বিশ্ব সমাজকে দাঁড়ানো উচিত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সমস্ত অপশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। যাতে করে দীপু দাসের মত একটি প্রাণও আর অকালে জঘন্য্য পাশবিক নির্যাতনের শিকারে পরিনত না হয়!

দীপু দাসের বৃদ্ধ মা বাবা আজ নির্বাক। কান্নাও ভুলে গেছেন! গরীর পরিবার। সে-ই ছিল এই পরিবারে একমাত্র উপার্জনকারী। তাঁর স্ত্রী পাথরের মত হয়ে গেছেন! তাঁর দেড় বছরের অবুঝ পুত্র এদিক ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে তার বাবাকে। সে হয়তো বুঝলে অভিশাপ দিত তার পিতার হত্যাকারীদের এই বলে যে, “তোরাও আমার মত পিতৃহারা হবি অচিরেই!”

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭৩০৩১