কিয়ার স্টারমারের ইউনুসের সঙ্গে বৈঠক করা উচিত নয়

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

ক্রিস ব্ল্যাকবার্ন-

আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে প্রতীকী বার্তার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনো রাজনৈতিক নেতা যখন কোনো বিদেশি নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বরং সেই দেশের নীতিমালা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের প্রতি তাদের অবস্থানের দৃষ্টান্তও স্থাপিত হয়। এ কারণে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমার এবং রাজা চার্লসের বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রধান মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে সম্ভাব্য সাক্ষাতের খবর যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।

এই খবর এসেছে এমন একটি সময়ে, যখন ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রবল সমালোচনা উঠছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফোর্টিফাই রাইটস, সিপিজে (সাংবাদিক সুরক্ষা কমিটি) এবং অন্যান্য সংস্থা একত্রে মার্চ মাসে একটি খোলা চিঠিতে ইউনুস প্রশাসনের অধীনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ওপর ধারাবাহিক দমন-পীড়নের অভিযোগ তোলে। জুন মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি পৃথক প্রতিবেদনে জানায়: “অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষপাতমূলকভাবে সাবেক ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের টার্গেট করা দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে আরও উৎসাহ দিচ্ছে।” ব্যাপকহারে নির্বিচার গ্রেপ্তার এখন এই সরকারের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে—যা তারা একসময় বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যে সহিংসতার ঢেউ শুরু হয়েছে, তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও নজরে এসেছে। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের প্রতিবেদক সাহার জান্দ এর নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধানী রিপোর্টে এসব হামলা তদন্ত করা হয় এবং তুলে ধরা হয় যে, ইউনুস প্রশাসন বরং এই সহিংসতার ঘটনা অস্বীকারে তৎপর থেকেছে। তাদের প্রচার টিম ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে বরং ঘটনাগুলোর সত্যতাকে অস্বীকারে মনোযোগী ছিল। সেই সঙ্গে, মানবাধিকার রক্ষাকারীদেরকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে এই সরকার তাদের কাজের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চালিয়েছে।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুস এক সময় আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ছিলেন ‘গরিবের ব্যাংকার’ হিসেবে। ক্ষুদ্রঋণের ধারণার পথিকৃৎ হিসেবে তিনি ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু আজ তিনি বাংলাদেশের এক অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান—একটি প্রশাসন যা ২০২৪ সালের রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে গঠিত হয় এবং যে সরকারের বিরুদ্ধে এখন স্বৈরতান্ত্রিক শাসন, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ উঠছে।

বিশেষভাবে উদ্বেগজনক হচ্ছে, এই সরকারের আওতায় হিন্দু সম্প্রদায়কে টার্গেট করার একাধিক ঘটনা, যেমন হরে কৃষ্ণ আন্দোলনকে মিথ্যা ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেওয়া। বাংলাদেশে প্রচারিত ভারত-বিরোধী বক্তব্যও সেখানে বসবাসরত হিন্দুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এমন বাস্তবতায় স্টারমার সরকারের উচিত ইউনুস প্রশাসন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করা। কারণ বিষয়টি শুধু নীতিগত নয়, প্রতীকীও। মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে স্টারমার একসময় কাজ করতেন ডাউটি স্ট্রিট চেম্বার্সে, যেটি বর্তমানে ইউনুস প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICC) মামলা পরিচালনা করছে। তাদের আইনি আবেদন অনুযায়ী, ইউনুস প্রশাসন “বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ও ব্যাপক আক্রমণ” পরিচালনা করছে—যার মধ্যে আছে নির্বিচার গ্রেপ্তার, নির্যাতন এবং সংখ্যালঘু ও নাগরিক সমাজের ওপর নিপীড়ন।

এই অবস্থায় স্টারমারের ইউনুসের সঙ্গে বৈঠক “নৈতিকতা নয়, বরং সুবিধাবাদের জয়” হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মার্চ মাসের যৌথ চিঠি কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন একক কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়—বরং এটি বাস্তব সংকটের প্রতি বৈশ্বিক মনোযোগ আকর্ষণের প্রয়াস।

সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, ইউনুসের সরকারের অধীনে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থান। একসময় প্রান্তিক করা হয়েছিল যে ইসলামপন্থী দলগুলোকে—আজ তারা আবার সক্রিয়, এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে কার্যত প্রশ্রয় পাচ্ছে। নিউইয়র্ক টাইমসের মতে, এসব গোষ্ঠী কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিচ্ছে, শিল্পী, নারী এবং অধিকারকর্মীদের হুমকি দিচ্ছে এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিকে দুর্বল করছে। বিশেষ উদ্বেগের বিষয় হলো জামায়াতে ইসলামীসহ অতীতের চরমপন্থী দলের সঙ্গে ইউনুস প্রশাসনের ঘনিষ্ঠতা।

উল্লেখ্য, ইউনুস এই পদে নির্বাচনের মাধ্যমে নয়, বরং নিয়োগের মাধ্যমে এসেছেন। সংবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে নির্বাচনের কোনো রূপরেখা না থাকা, এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের বদলে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ—সব মিলিয়ে এই সরকার একটি সেতু নয়, বরং এক প্রকার “গণতন্ত্রের প্রতিরোধক ব্যারিকেডে” পরিণত হচ্ছে।

এই মুহূর্তে ইউনুসের সঙ্গে কোনো কূটনৈতিক সাক্ষাৎ কেবল সাময়িক বিতর্কই নয়, বরং এমন এক প্রশাসনকে বৈধতা দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে—যেটি এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার কোনো প্রকৃত প্রতিশ্রুতি দেখায়নি।

স্টারমারের অভিবাসন বিষয়ক পূর্ববর্তী বক্তব্য—বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসীদের প্রত্যাবাসনে অসহযোগিতার অভিযোগ—ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে আগেই অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। এর ফলে কয়েকজন লেবার কাউন্সিলর পদত্যাগ করেন, এবং ঐতিহাসিকভাবে লেবারপন্থী এই সম্প্রদায়ের সমর্থনে ভাটার টান শুরু হয়। এমতাবস্থায় ইউনুসের সঙ্গে বৈঠক ওই ক্ষতিকে আরও গভীর করতে পারে।

এই গল্প নতুন কিছু নয়। ২০১৬ সালে মিয়ানমারের শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্ব কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে। পরে তার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধন চালায়। সেই সময়ের বিশ্বনেতারা পরে নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু হটেন। ইউনুস প্রশাসনও আজ সেই অনুরূপ সমালোচনার মুখে—তার অতীত নোবেল অর্জন নয়, বর্তমান কার্যক্রমই তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে।

এটি কোনোভাবেই কূটনীতি-বিরোধিতা নয়। বরং এমন সময়ে কূটনৈতিক সম্পর্কের নামে “নৈতিক বৈধতা” দেওয়া অত্যন্ত বিপজ্জনক।

যদি যুক্তরাজ্য নিজেকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থানকারী দেশ হিসেবে তুলে ধরতে চায়, তাহলে এই ধরনের সিদ্ধান্তে নীতিগত স্পষ্টতা থাকা জরুরি। মাঝে মাঝে ‘সঠিক কাজ’ মানে হলো সেটা না করাই, এমনকি যদি টেবিলের অপর পাশে বসা মানুষটির গলায় নোবেল মেডেল ঝুলে থাকে।

 

লেখক-  কমিউনিকেশন  ডাইরেক্টর   ইউরোপীয় বাংলাদেশ ফোরাম

 

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০