বিশেষ প্রতিবেদন
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত ও মানবিক সংকটের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা উঠেছে। বিশেষ করে, মানবিক করিডোর প্রতিষ্ঠা এবং নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের বিষয়ে সরকারের নীতিকে অনেকেই দ্ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন। একদিকে সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর কথা বলছেন। অন্যদিকে মানবিক করিডোর করে আরও রোহিঙ্গা প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে।

২০২৫ সালের শুরুতে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষণা দেন যে, মিয়ানমার প্রথম ধাপে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে । তবে, এই ঘোষণা বাস্তবায়নের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। পরবর্তীতে, ইউনূস জানান যে, রাখাইনে সহিংসতার কারণে গত কয়েক মাসে ৮০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে । পরে জানা যায়, এই সংখ্যা এক লাখ ১৩ হাজার। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের বাংলাদেশ সফর এবং রোহিঙ্গা শিবিরে ইফতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকে অনেকেই রাজনৈতিক নাটক হিসেবে দেখছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি উঠেছে যে, এই সফর এবং ইউনূসের মন্তব্যের মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভুয়া আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবে কার্যকর হয়নি ।
এরপর সামনে এসেছে রাখাইনের মানবিক করিডোর ইস্যু। এই প্রস্তাব নিয়ে দেশে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ স্পষ্ট। সেনাবাহিনীর একটি অংশও করিডোর স্থাপনের বিরোধিতা করছে, কারণ এটি দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হতে পারে ।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরকালে মানবিক করিডর দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। তবে দেশের অভ্যন্তরে তীব্র সমালোচনার মুখে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, করিডর নয়, বাংলাদেশ আসলে প্যাসেস দিচ্ছে।
তার ভাষায়, করিডর ও প্যাসেসের মধ্যে বিস্তর তফাত। যদিও কী তফাত সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই বলেননি তিনি। ফলে একটা ধূম্রজাল চারপাশে ঘিরে আছে। কী হচ্ছে মানবিক করিডর নিয়ে! কেন এই লুকোচুরি! রোহিঙ্গাবিরোধী কট্টর বৌদ্ধদের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরাকান আর্মিকে মানবিক সহায়তা দিলেও তা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে কোনো সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। বরং নতুন করে রোহিঙ্গা বিতাড়িত করে বাংলাদেশে পাঠাচ্ছে।
একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, মিয়ানমার কিংবা আরাকান আর্মি কেউই মানবিক সাহায্য চায়নি। রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা জাতিসংঘের তরফে বলা হলেও মিয়ানমার এমন কোনো আশঙ্কা করছে না। জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশে দেশে করিডর দেওয়া হলেও সেগুলোর পরিণতি ভয়াবহ হয়েছে। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও অন্তর্বর্তী সরকার করিডর নিয়ে কী হচ্ছে তা খোলাসা করছে না।
রাখাইনে সহায়তার জন্য মানবিক করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্তের পূর্বে নিরাপত্তা ঝুঁকি, সামরিক প্রসঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ ও জাতীয় ঐকমত্য জরুরি বলে মনে করেন বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেছেনন, ভূ‚রাজনৈতিক সুবিধার কারণে কেউ আমাদের কাছে করিডোর চাইল আর আমরা তাতে সম্মতি দিয়ে দিলাম, এটা তো চরম অদূরদর্শী ও আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের সামিল। একটি মানবিক করিডোরের আড়ালে সামরিক করিডোর স্থাপন করতে চায় এবং এর ফলস্বরূপ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে তাদের আলাদা খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নপূরণ করতে চায়।
বাংলাদেশ যদি মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্মতি ছাড়াই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করিডোর খোলে, তবে এটি সরাসরি দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা যাবে। রাখাইনে এখন মূলত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ, যারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর (তাতমাদো) সঙ্গে যুদ্ধরত বিদ্রোহী সংগঠন। করিডোর খোলার মানে হবে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রিত এলাকায় সরাসরি ত্রাণ পাঠানো, যা কার্যত তাদের স্বীকৃতি দেওয়া এবং পরোক্ষ সহায়তা করা। এর ফলে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর চোখে “শত্রু রাষ্ট্রে” পরিণত হতে পারে।
এই করিডোর কাদের দ্বারা পরিচালিত হবে? কোন বাহিনী তা রক্ষা করবে? সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে কারা থাকবে? এই প্রশ্নগুলোর কোনো পরিষ্কার জবাব এখনো মেলেনি। একটি খোলা করিডোর অস্ত্র ও মাদকের চোরাচালান, সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ, এবং সীমান্তে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে পারে। তদুপরি, এই করিডোর আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক খেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা বিশ্ব ব্যবহার করতে পারে, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য দীর্ঘমেয়াদে হুমকিস্বরূপ হতে পারে।
চীন ও ভারত—উভয়ই রাখাইন অঞ্চলে বিশেষ স্বার্থ রক্ষা করছে। চীন আরাকান তেল ও গ্যাস পাইপলাইন এবং অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে রাখাইনকে ব্যবহার করছে, আর ভারত কলাদান মাল্টিমোডাল প্রকল্পে রাখাইনকে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশ যদি একটি মানবিক করিডোরের মাধ্যমে এই এলাকায় পশ্চিমা প্রভাব প্রবেশের সুযোগ করে দেয়, তবে তা আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে এবং চীন-ভারত উভয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাখাইন এখন আরাকান আর্মির দখলে। সেখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, আরাকান আর্মি, এবং সাধারণ রোহিঙ্গা জনগণের মধ্যে সংঘাতের ত্রিমুখী অবস্থা বিরাজ করছে। মানবিক করিডোর খোলার পর তা যদি আরাকান আর্মির হাতে চলে যায়, তাহলে জাতিসংঘের কর্মীরাই বিপন্ন হতে পারেন। আরও ভয়ঙ্কর হলো—এই করিডোর যদি কার্যত রোহিঙ্গাদের পালিয়ে আসার নতুন পথ হয়ে দাঁড়ায়, তবে এটি নতুন রোহিঙ্গা ঢলের জন্ম দেবে, যা বাংলাদেশের পক্ষে আর বহন করা সম্ভব নয়।
রাখাইনের মানবিক সংকট অবশ্যই আন্তর্জাতিক সহানুভূতির দাবি রাখে। তবে বাংলাদেশ যদি আবেগ নয়, বরং কৌশলগত বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত নেয়, তবে এই ধরনের একটি করিডোর থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই হবে শ্রেয়। রোহিঙ্গা সমস্যা ইতোমধ্যেই দেশের কাঁধে অনেকটা চাপ সৃষ্টি করেছে। এখন করিডোরের নামে আরেকটি সংকট আমদানি করার আগে জাতীয় স্বার্থ, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক ভারসাম্য সব দিক বিবেচনায় দেখা জরুরি।