বিএনপি ছাড়া অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কি আদৌ সম্ভব?

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
জুয়েল রাজ-

বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হতে পারে, সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকার ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার উপর নানাভাবে যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে চলেছে বিগত কয়েক মাস ধরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আমেরিকার ভূমিকা নিয়ে প্রকাশ্যে নানা বক্তব্য দিয়েছেন, যা দুই দেশের সম্পর্ককে বৈরী করে তুলেছিল বলেই ধারণা।

 

বিশেষ করে, বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস দৃষ্টিকটুভাবেই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছেন এবং একটি ধারণা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, আর যাই ঘটুক, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত হবে না। বিএনপিও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সেই অবস্থানের জানান দিচ্ছিল।

 

যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেইবারবার বলে আসছেআসন্ন জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক। এই নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জন্য তাদের নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করে। বাংলাদেশের নির্বাচন কেন্দ্র করে এখনওতারা যথেষ্ট সক্রিয়। বাংলাদেশের নির্বাচন শুধু আমেরিকা নয় ভারত এবং চীনের অবস্থান নিয়েও একটি বড় বিষয় সেখানে, ভারত এবং চীন বাংলাদেশের নির্বাচনে তাদের ভূমিকা নিয়ে গত সপ্তাহে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরসক্রিয়তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা। কারণ, ভারত মনে করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবও মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাবে, যা ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ব্যাখ্যা ভারত আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে নানাভাবে জানিয়েছে।

 

বাংলাদেশের জনগণই তা ঠিক করবেন। তাঁরাই তাঁদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারত। সে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে সে দেশের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারত বরাবর সমর্থন করে আসছে। সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে।

 

চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েনও গত সপ্তাহে রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বিআরআইয়ের ১০ বছর: পরবর্তী সোনালি দশকের সূচনা’ শীর্ষক সেমিনারে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ‘বাংলাদেশের সংবিধান মেনে চলার’ ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন দেখতে চায় চীন।

 

সর্বশেষ স্থানীয় সময় মঙ্গলবার নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার, এদিনের ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নকারী বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান জানতে চান। তিনি প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সহিংসতার পথ বেছে নেওয়ায় তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করতে ভূমিকা রাখছে বলে কি আপনি মনে করেন? জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, আমরা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দেখতে চাই। আমরা এমন নির্বাচন দেখতে চাই যেটি শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে। এটাই আমাদের নীতি এবং এই বিষয়টি আমি এখান থেকে বেশ কয়েকবার স্পষ্ট করে বলেছি। পরে ওই প্রশ্নকারী জানতে চান, আপনি কি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের প্রেক্ষাপটে বিএনপির সংগঠিত রাজনৈতিক সহিংসতার নিন্দা করবেন? জবাবে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এই মুখপাত্র বলেন, আমি মনে করি, আমি আমার আগের জবাবেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছি।

 

এই মুহূর্তে আসলে বাংলাদেশের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ করা না করার চেয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রশ্নটি এখন সবচেয়ে বড়ো বিষয়।

 

সংবিধানের ধারাবাহিকতাবজায় রেখেনির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চললে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে আইনত কোন বাধা বিপত্তি নাই। সরকারি দল হিসাবে আওয়ামী লীগ পুরোদমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে।

 

কিন্তু সবকিছুর মাঝেও দেশে-বিদেশে , সাধারণ মানুষসহ কূটনৈতিক মহল, সব জায়গায় আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বিএনপি ছাড়া এই নির্বাচন আদৌ সম্ভব কি না, সম্ভব হলে সেই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কি?আমেরিকার মতো দেশের আগ্রাসী অবস্থানের কারণে ভীতি কাজ করছে জনমনে।

 

এখন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন মানে কি শুধুই বিএনপির অংশগ্রহণ, নাবেশিসংখ্যক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ, সেটিও একটি প্রশ্ন। গত সপ্তাহে নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার পর , দেশের নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি দল এই তফসিলকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবংতফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে ১৫টি দল। যার মধ্যে বিএনপি ছাড়া বাকি সব দলই আসলে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দল। তৃতীয় বৃহৎ রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টি সে সময়নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে তেমন কিছুই বলেনি।

 

কিন্তু আজকে জাতীয় পার্টি এবং যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণার মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পথ সুগম করে দিয়েছে। যুক্তফ্রন্টের আজকের অনুষ্ঠানে সৈয়দ ইবরাহিম বলেন, যুক্তফ্রন্ট আগামী নির্বাচনে ১০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি আছে। নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়ার তারিখ ৩০ নভেম্বর থেকে পেছানো হতে পারে। নির্বাচনের ভোট গ্রহণসহ অন্যান্য তারিখও পেছানো হতে পারে। এদিকে, কল্যাণ পার্টির সঙ্গে নতুন গঠিত যুক্তফ্রন্টে আছে জাতীয় পার্টি (মতিন), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ।

 

পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পেয়ে হঠাৎ আলোচনায় আসা তৃণমূল বিএনপি ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথা বলছে। অন্যদিকে , বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১২৫ জন নেতা স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চের ব্যানারে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। বিএনপি দলগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা স্বতন্ত্র গণতন্ত্র মঞ্চের ব্যানারে ১২৫ জন বিএনপি নেতা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

 

নির্বাচনের একেবারে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রাম , হরতাল-অবরোধ কিংবা জ্বালাও-পোড়াও নীতিতে নির্বাচন বানচাল এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি, শেখ হাসিনার পদত্যাগ কিছুই অর্জন করা সম্ভব হয়নি। বিএনপির সামনে এখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছাড়া আসলে আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে ও বিএনপি ব্যর্থ হয়েছিল তাই একই ব্যর্থতা নিয়ে আবারও রাজপথের আন্দোলন দিয়ে সফলতা আশা করা কতটা যুক্তিযুক্ত তা বিএনপির নেতৃত্বই ভালো বলতে পারবেন।

 

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিরচেয়ে বরং বিএনপি যদি খালেদা জিয়ার মুক্তি কিংবা তারেক জিয়ারনিরাপদে বাংলাদশেপ্রত্যাবর্তন নিয়ে আন্দোলন করত সেটি বরং তাদেরকে ব্যাপকভাবেজনসম্পৃক্ত করার সুযোগ করে দিত। পারিবারিক ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের আবেগ জড়িত। দেশের জনগণের বৃহৎ একটি অংশ জিয়া পরিবারের প্রতি এখনো তাঁদের আবেগ ধারণ করেন। সেই সব সাধারণ মানুষকে বিএনপি, তাদের সাথে বিগত ১৫ বছরেও সম্পৃক্ত করতে পারেনি। বরং আওয়ামী লীগের সাথে এক অসম যুদ্ধে লিপ্ত থেকেছে, যে যুদ্ধে তাঁদের প্রধান সেনাপতিই অনুপস্থিত।

 

অবিশ্বাস ও নেতৃত্বহীনতা দিয়ে কোনো যুদ্ধেই জয়লাভ করা সম্ভব নয়। বিএনপির ক্ষেত্রে দুইটাই আছে । নির্বাচন কমিশন বলেছে বিএনপি যদি এখনও নির্বাচনে অংশ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে , তাহলে নির্বাচন কমিশন সেই সুযোগ তৈরি করে দিবে। নতুন করে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচনের দিনক্ষণপরিবর্তন করবে। বিএনপিকে বেঁচে থাকতে হলে এবারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না।

 

বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে, বিএনপির স্থানীয় নেতারাই আসলে বিভিন্ন দলের হয়ে স্বতন্ত্র হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন, আর এতে করেআওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি এবং স্বতন্ত্র বা বিভিন্ন জোটের প্রার্থীদের মধ্যে প্রতিদ্ধন্ধিতামূলক একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সেটি এখন নিশ্চিত প্রায়।

 

খেলা হবে, কিন্তু বিএনপি মাঠে নয় দর্শক গ্যালারিতে বসে থাকবে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট,সম্পাদক ,ব্রিকলেন ।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০