বঙ্গবন্ধু বাকশাল ও কিছু কথা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
রাজিক হাসান:

আমাদের ভারতবর্ষের শাসনভার হাজার বছর ধরেই ছিল উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তদের হাতে। সাধারণ মানুষের কোন অধিকার ছিল না সেখানে। শাসকের খেয়ালখুশিই ছিল আইন। বিদেশী শাসকরাও আমাদের শাসন করেছে সেই উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তদের হাত করেই। সিরাজের পতনের পর ইংরেজরা আসে। তারাও শাসন শোষণ দুইই করেছে। সময়ের প্রয়োজনে সেই উচ্চবর্ণ ও উচ্চবিত্তদের হাতেই গণতান্ত্রিক ক্ষমতা দিয়ে তারা চলে গেছে। শেখ মুজিব এই ভারতবর্ষের একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই অভিজাততন্ত্রকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়ে সাধারণ মানুষের হাতের ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যেই সামরিকবাহিনীর সহযোগিতায় অভিজাতরা আবার তা ছিনিয়ে যায়।

বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয় তখন আমি কথা বলতেও শিখি নি। তারপর যখন বড় হতে শুরু করলাম, তখন থেকেই একটি কথা শুনে আসছি; বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল বাকশাল গঠন। আর তাই তখন থেকেই বাকশাল নিয়ে আমার আগ্রহ। পত্রপত্রিকায় যা পড়েছি তার সারকথা ছিল বাকশাল হলো শেখ মুজিবের একনায়কতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার নাম। আর এই কারণে সেনাবাহিনী তাঁকে হত্যা করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছে।

১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে নানান কিচ্ছা কাহিনি শুনেছি। জাল পরে লজ্জা নিবারণ করছে বাসন্তী নামের একটি মেয়ে সে ছবিও আমরা দেখেছি। কেউ বল নি ঐটি প্রোপাগান্ডা ছিল, একটা শাড়ির চেয়ে জালের দাম অনেক বেশি। কেউ বলে নি যে, ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ফলাফলেই ছিল এই দুর্ভিক্ষ। যদিও বঙ্গবন্ধু দুর্ভিক্ষের দায়ভার নিয়ে কোনো ভণিতা করেননি। সকল ব্যর্থতার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন। জাতীয় সংসদে দুর্ভিক্ষে প্রাণহানির সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন।

একদিকে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বঙ্গবন্ধুকে যেমন খুব মর্মাহত করেছিল, অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল বামপন্থীদের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড। সারা দেশ যখন দুর্ভিক্ষের ছোবলে একদম মৃতপ্রায় তখন কর্নেল তাহের গড়ে তোলেন তাঁর গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী গণবাহিনী। জাসদও বসে নেই। দেশের এই চরম দুর্দিনে জাসদ প্রতিটি সেনানিবাসে গড়ে তোলে তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা | জাসদতো ১৯৭৩ সালের তাদের প্রথম জাতীয় অধিবেশনেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তা ধারাকে তাদের আদর্শ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্যে স্থির করে শেখ মুজিব সরকারকে বুর্জোয়া শোষক শ্রেণির সরকার আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। এই বামপন্থীদের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডের শুরু কিন্তু স্বাধীনতার ঠিক পর থেকেই।

অন্যদিকে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রেণিমুক্ত ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলা’ গঠন করার লক্ষ্যে আরেক স্লোগানধারী সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলার সর্বহারা পার্টির ক্যাডাররা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪৯২৫টি গুপ্তহত্যা করেছিল। ৬০টি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট করে জনজীবনকে অস্থির করে তুলছিল।

১৯৭২-৭৩ সালের এই সময়টাতে পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপিসহ বেশির ভাগ মুসলিম ভাবাপন্ন রাজনৈতিক দল গোপনে জুলফিকার আলীর প্রেসক্রিপশনে ‘মুসলিম বাংলা’ কায়েমের তাদের সকল শক্তি নিয়ে তৎপরতা চালিয়েছিল। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাওলানা ভাসানী এদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করব।’ সেই সময়টিতে তিনি খুব দায়িত্বহীনের মতো অনেক আচরণ করেছিলেন। তিনি হিন্দুদের উদ্দেশ্যে বলে বসলেন, ‘জয় বাংলা এবং আওয়ামী লীগ তোমাদের রক্ষা করতে পারবে না। তোমাদের ভাগ্য বিহারিদের মতোই হবে।’ দুর্ভিক্ষের চরম সংকটকালে এই উগ্র বামপন্থী ও মুসলিম বাংলা কায়েমকারীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও গোপন তৎপরতা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু বাকশালকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলেছিলেন | ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর এটি ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব | তবে বাকশালের মতো বিপ্লবী উদ্যোগ পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। এর আগেও অনেক দেশে হয়েছে। কিন্তু এর আগে যেটি কখনোই হয়নি সেটিই করে দেখালেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেটি করলেন দেশের বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের বিধি মেনে।

বাকশালের মূল কার্যক্রম বুঝতে এখানে কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি—১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের বেশ কিছু স্বল্পকালীন ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসূচি ও কার্যক্রম সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে। আমার জায়গা হলো ৫৫ হাজার বর্গমাইল। যদি প্রত্যেক বছর ৩০ লক্ষ লোক বাড়ে তাহলে ২৫-৩০ বছরে বাংলার কোনো জমি থাকবে না চাষের জন্য। বাংলার মানুষের বাংলার মানুষের মাংস খাবে, সে জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হলো তিন নম্বর কাজ। এক নম্বর হলো দুর্নীতিবাজ খতম করুন। দুই নম্বর হলো কারখানায়-খেতে খামারে প্রোডাকশন বাড়ান, তিন নম্বর পপুলেশন প্ল্যানিং আর চার নম্বর হলো জাতীয় ঐক্য। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য এক দল করা হয়েছে। যারা দেশকে ভালোবাসে, যারা এর আদর্শে বিশ্বাস করে, চারটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ মেনে সৎ পথে চলে তারা সকলেই এই দলের সদস্য হতে পারবেন। যারা বিদেশি এজেন্ট, যারা বহিঃশত্রুর কাছ থেকে পয়সা নেয় এতে তাদের স্থান নেই। সরকারি কর্মচারীরাও এই দলের সদস্য হতে পারবে। কারণ তারাও এই জাতির একটা অংশ। তাদেরও অধিকার থাকবে এই দলের সদস্য হওয়ার। এই জন্য সকলে যে যেখানে আছি একতাবদ্ধ হয়ে দেশের কাজে লাগাতে হবে।’

স্বনির্ভর কর্মোদ্যমের একটি উদাহরণ টেনে তিনি বলেছিলেন—”আমি খবর পেলাম, ঠাকুরগাঁওয়ে একটা কোল্ড স্টোরেজ করা হয়েছে। এক বছর আগে সেটা হয়ে গেছে। কিন্তু পাওয়ার নাই। খবর নিয়ে জানলাম, পাওয়ার সেখানে যেতে এক বছর লাগবে। কারণ খাম্বা নাই। খাম্বা নাকি বিদেশ থেকে আনতে হবে। মিনিস্টার সাহেবকে বললাম খাম্বা টাম্বা আমি বুঝি না। বাঁশ তো আছে। এখানে দাঁড়াও, খাম্বা কাটো, দা লাগাও। দেড় মাস, দুই মাসের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। এটা লাগাও। কি করে লাগবে, সেটা আমি বুঝি টুঝি না। দিল, লেগে গেল। কিন্তু ও আমার কাছে যদি না আসত, এক বছরের আগে খাম্বা পেত না, ওটা হতো না। এভাবে পাওয়ার গেল, আলু রাখল। এই মেন্টালিটি কেন হয়? খাম্বা বাংলাদেশের গাছে গাছে হয়। আমি বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় পাওয়ার দিতে চাই। কো-অপারেটিভও আমি প্রতিটি গ্রামে করতে চাই। এটা সোজাসুজি বাঙালি কো-অপারেটিভ যাকে বলা যায় মাল্টিপারপাস কো অপারেটিভ। আমি নিজে ঠিক করেছি আমার পদ্ধতি। প্রথমে এরিয়া ভাগ করে নেবেন। এমন জায়গায় নেবেন, যেখানে আমি ইমিডিয়েটলি পাওয়ার দিতে পারি। ধরুন যদি রাজশাহীতে যদি করি তাহলে এমন জায়গায় করতে হবে যেখানে পাওয়ার নিতে পারি। এভাবে একটা দুটা তিনটা গ্রাম নিয়ে কো-অপারেটিভ করতে হবে এবং এটা হবে কমপালসারি কো-অপারেটিভ। এতে কোনো কিন্তু-টিন্ত নেই।”

এই বিশাল কর্মোদ্যোগকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে এর পেছনের কারণ গুলো কি? বঙ্গবন্ধু কোনো সাম্রাজ্যবাদী দেশের প্রেসক্রিপশনে চলার মানুষ ছিলেন না। অর্থনৈতিক এই বিপ্লবটি সফল হলে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম প্রধান অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে যাবে। সুতরাং শেখ মুজিবকে খতম করে বিশ্বব্যাংকের কথামত যারা চলে তাদের নিয়ে আসো। হলোও তাই। জাতি হারাল তার সবচেয়ে সুদৃঢ় নেতাকে।

(দেশপ্রসঙ্গ পত্রিকাতে প্রকাশিত)

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০