অস্থিরতা ও অশান্তি উন্নয়ন নয় –

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

শৈলেন কুমার দাশঃ 

মানুষের জীবন কতগুলি সুন্দর অধ‍্যায়ের সাথে যুক্ত। যার সুন্দর, সাবলীল বিকাশের মধ‍্যেই মানুষের বিকাশ ও উন্নয়ন নিহীত। এ অধ‍্যায় গুলি হলো,  অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি। এ গুলির সুন্দর, সমন্বিত বিকাশের মধ‍্য দিয়ে মানুষের জীবন সুন্দর হয় ; অর্থবহ হয়। প্রতিফলন ঘটে মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার। শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে জীবন ধাবিত হয়। প্রেমে, অনুরাগে, ভালবাসার বন্ধনে মূর্ত হয় মানবিকতা, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। শান্ত নিবির জনপদ স্পন্দিত হয় মানুষের কর্মে। প্রাণচাঞ্চল‍্যের মধ‍্য দিয়ে কর্মের প্রেরণায় মানুষ প্রতিনিয়ত রুপান্তরিত হয়  সুন্দর মানুষে। চিন্তায় বিকশিত হয় কর্মের সুন্দর ধারণা, আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মান। অপরের প্রতি ও অন‍্য মতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষাও এখানে প্রোথিত। সুতরাং কোন একটি বিষয়কে বাদ দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। যা মূলতঃ আংশিক উন্নয়নের পথ ধরে অগ্রসর হয় এবং প্রকট হয় অন‍্য নতুন সমস‍্যা। সমাজের উন্নয়ন ধারায় মানুষের জীবনের এ অধ‍্যায় গুলির সম গুরুত্ব প্রদান একান্ত  আবশ্যক। তা না হলে এক অধ‍্যায় এগিয়ে যাওয়া এবং অন‍্য অধ‍্যায় পিছিয়ে যাবার কারণে সমাজ জীবনে তৈরী হয় এক অশান্ত উন্নয়ন ধারা। যা ক্রমশই  অশান্তির পথ ধরে অগ্রসর হয় এবং  প্রকৃত উন্নয়ন বলে গণ‍্য হয় না। এ বিষয়ে বিশ্বনন্দিত শিক্ষাবিদরাও বলেছেন –
” Economic, social, political and cultural aspects strive to develop freedoms, privilege, rights, consciousnesses and entitlements that individuals and community require to live a life of dignity.” অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় গুলি সুসমন্বিতভাবে মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ উন্নয়নের উপর জোর দেয়। যা মানুষের স্বাধীনতার ক্ষেত্রসমূহ, সঠিক অধিকার ও এর অগ্রাধিকার প্রণয়ন, সচেতনতার ভীত তৈরী করে এবং ন‍্যায‍্য ও যোগ‍্য অধিকার লাভ নিশ্চিত করে। যার মধ‍্য দিয়ে ব‍্যক্তির জীবন ও সমাজ মর্যাদাপূর্ণ হয়।

আমাদের দেশের বর্তমান উন্নয়ন ধারায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেকটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সত‍্য। রাস্তা, ঘাট, ব্রীজ, বিল্ডিং ও পদ্মাসেতুর মত মহাস্হাপনা দেশের নিজস্ব সম্পদে তৈরী হয়েছে। কিন্তু এখনও কি রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের প্রতি নূন‍্যতম সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হয়েছে? যারা অমানবিক পরিশ্রমের বদৌলতে (বিশেষ করে মধ‍্যপ্রাচ‍্যে যারা কাজ করেন) দেশে রেমিট্যান্স পাঠান। তাদের কথা কেউ ভাবেনা। তারা নিজের যৌবনের সুন্দর সময়  বিলিয়ে দিচ্ছে মধ‍্যপ্রাচ‍্যের খর উত্তাপে। দেশে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। তাদের জন‍্য কর্ম সংস্হান তৈরীর কার্যকরী ও চোখে পড়ার মত উদ‍্যোগ কোথায়? তাই দেশ ছাড়তে উদগ্রীব শিক্ষিত ও কম শিক্ষিত বেকার যুবকেরা। যুবসমাজের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ভাবনায় একজন মন্ত্রী মহোদয়েরও উদ‍্যোগী ভূমিকা দেখা যায়নি। যা ভাবেন একমাত্র প্রধানমন্ত্রী। সবার সম্মিলিত  উদ‍্যোগী ভূমিকা ছাড়া তো সম্ভাবনাময় যুব সমাজকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো সম্ভব নয়। ফলে মধ‍্যপ্রাচ‍্যের মত অমানবিক কাজে, মধ‍্যপ্রাচ‍্যের অতি গরমে রাস্তাঘাটে পরিচ্ছন্নতার কাজে যেতে বাধ‍্য করছি আমরা তাদেরকে। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়দের বলছি আপনাদের এই সুবর্ণ সময় ও সুযোগ কাজে লাগিয়ে যুব সমাজের কর্মসংস্থানের কার্যকরী  উদ‍্যোগ গ্রহণ করুন। কারণ এরাই দেশের সুন্দর ভবিষ্যতে বিনির্মাণের অগ্রপথিক। আর আপনাদের যদি এসব উদ‍্যোগ গ্রহণ করতে তথ‍্যের ঘাটতি থাকে তাহলে যারা এ কাজে পারঙ্গম তাদেরকে কাজের সুযোগ করে দিন। এতে আপনাদের সম্মান নষ্ট হবে না। বরঞ্চ শ্রদ্ধা ভালবাসায় স্মরণ করবে আপনাদেরকে আমাদের যুব সমাজ। তাদের জন‍্য স্বপ্নসম ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার জন‍্য। এক্ষেত্রে প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্ণধার ডঃ কাজী ফারুক আহমদসহ তাঁর মত আরো যারা আছেন তাঁদের কাজে সহযোগিতা করুন বা কাজে লাগান। তাঁরা যুব সমাজের কর্ম সংস্হান সৃষ্টিতে সময়োপযোগী অনন‍্য ভূমিকা রাখবেন। এমন কাজে আপনাদের সম্মান বাড়বে বৈ কমবে না। ফলে যুব সমাজের শক্তিশালী অব‍্যবহৃত বিশাল শ্রম উৎপাদনশীল কাজে বিনিয়োগ হয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অধিক শক্তিশালী করবে।

সামাজিক সম্পর্ক তো আজ facebook এর উন্মাদনার নাগপাশে আবদ্ধ। এই উন্মাদনা মূহূর্তেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে দীর্ঘদিনের পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন। এ বিষয়ে ক্ষমতায় আসীন যারা তাঁরা কেন কিছু করছেন না বা কেন করতে পারছেন না বোধগম‍্য নয়!  যার ফলে রামু, সাথিয়া, হোমনা, মালোপাড়া,  নাসিরনগর,  ঠাকুরগাঁ, বানারীপাড়া, কলমাকান্দা, গোবিন্দগঞ্জ, কুমিল্লা, শাল্লা, গঙ্গাছড়া, পীরগাছা, রাঙ্গুনিয়া ও লোহাগড়া সহ আরও  অনেক জায়গায় সংগঠিত হয় হিন্দুদের উপর করুণ নির্যাতন। এছাড়াও বিগত দূর্গাপুজায় ২৬টি জেলায় পুজামন্ডবে আক্রমণ হয়। যা মূলতঃ দুর্বল সামাজিক সম্পর্কেরই নামান্তর। বিচারহীনতার সংস্কৃতিই এক্ষেত্রে প্রনোদনা দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। জানিনা এ ধরনের রাজনীতি কোন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় বহন করে? সুতরাং দেশের সামাজিক  উন্নয়নের অধ‍্যায় খুবই দুর্বল আভরণে সজ্জিত।

রাজনৈতিক অধ‍্যায়ের কথা যদি বলি, গ্রামে গঞ্জে পর্যন্ত রাজনৈতিক দল গুলির বিস্তৃতির কারণে গ্রামীণ  সম্পর্কও আজ দলীয়করণের আবর্তে আবর্তিত। গ্রামে গ্রামে লোকজন দলীয় হানাহানিতে লিপ্ত। মেম্বার নির্বাচন নিয়ে পর্যন্ত মারামারি খুনাখুনি। ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ছিল আগে উৎসব মূখর ও গ্রামীণ বিনোদনের কর্মকাণ্ডের একটি। এখন আর সেটি নেই। আমি dicentralization এর বিরুদ্ধে নই। তবে এর আগে অবশ‍্যই সক্ষমতা তৈরী এবং এর গুরুত্ব বুঝার প্রশিক্ষণ দেয়া প্রয়োজন ছিল।  এখানে আমার একটি পারিবারিক  উদাহরণের অবতারণা করছি। যা এর সাথে অনেকটা সঙ্গতিপূর্ণ। গল্পটি আমার মায়ের কাছে শুনা। আমার পিতামহ বাবু সদয় চাঁন মহাশয় ছিলেন একজন সজ্জন, সম্ভ্রান্ত এবং ধনবান ব‍্যক্তি। বিনয়ী, সদালাপী, সাস্ত্রীয় জ্ঞানের অধিকারী মানুষটি জমি বর্গা দিতে গিয়েও বর্গাগ্রহণকারীর পারিবারিক ঐতিহ্য, আচরণ ও বংশ পরিচয় দেখতেন। একদিন সাহস করে আমার মা উনার শ্বশুর মহাশয়কে বলেন -তাতশ্রী মানুষ পুত্র কন‍্যার বিয়ের সময় বংশ দেখে আত্মীয়তা করে। আপনি তো জমি বর্গা দিতে গিয়েও বংশ দেখেন। কারণ কি? আমার মা তখন নতুন বউ। তবু সাহস করে প্রশ্নটি করেছিলেন কৌতুহলের নিবৃতির জন‍্য। উত্তরে তিনি বলেন – মাগো আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি মানুষের মনে কষ্ট দেয়া পাপ; তাকেই আমি অধর্ম বলে জানি। মানুষকে একটু সুখ দেয়া, শান্তি দেয়াই ধর্ম এবং ন‍্যায়। আমি যদি ভাল মানুষ দেখে জমি বর্গা না দেই তাহলে সে আমার জমির আশে পাশের লোকেদের অশান্তির কারণ হবে। তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবে সে বেশী জমির চাষী হবার কারণে। তখন মানুষ কষ্ট পাবে এবং আমার প্রতিও অসন্তুষ্ট হবে। সেজন‍্য আমি বংশ খূঁজি মা। আমার মা এ গল্পটি আমাকে অনেক বার বলেছিলেন। সুতরাং দলীয় রাজনৈতিক মহান দায়িত্ব অর্পণের সময়  অবশ‍্যই বংশ না দেখলে ও অন্ততঃ ভাললোক ও প্রশিক্ষিত জনের উপর দায়িত্ব  অর্পন করা উচিৎ ছিল। ফলে যে রাজনৈতিক সমস‍্যা গুলির আবর্তে আবর্তিত হচ্ছে গ্রামীণ জনপদ তা হতো না। আমার ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি অধিকাংশ লোকজনই অদক্ষ ও অভিজ্ঞতা বিহীন। ক্ষমতা ধারণ করার ক্ষমতা বা এর সংযত, সুন্দর ব‍্যবহারের   ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে যত্রতত্র ক্ষমতার ব‍্যবহার হচ্ছে। যা দেশব‍্যপী অস্হিরতা ও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি অযোগ্যতা ও অদক্ষতারই ফসল। রাজনীতি সমন্ধে বিখ‍্যাত গ্রীক দার্শনিকদের এখানে একটু স্মরণ করা দরকার। তাঁদের মতে “Politics is the set of activities that associated with making decisions in groups or other forms of power relations among individuals, such as the dustribution of resources or status.” রাজনীতি এমনই কতগুলি সৃজনশীল কর্মকান্ডের সমন্বিত রুপ যার সাথে দেশ ও মানুষের সুখ, সমৃদ্ধি ও শান্তির জন‍্য দলীয়ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া যুক্ত। সেই সাথে রাজনীতি ব‍্যক্তিবর্গের ক্ষমতা সম্পর্কের এক সমন্বিত সুন্দর রুপ যা সম্পদ ও মর্যদার সুবিন‍্যাস্ত বণ্ঠনে বিশ্বাসী। এ প্রক্রিয়া সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সমান সুফল নিয়ে আসে। তাই আমাদের প্রিয় রাজনীতিবিদদের একটু ভেবে দেখার জন‍্য অনুরোধ করছি। এর আলোকে আমাদের রাজনীতি কোথায়? ক্ষমতা, সম্পদ, সুযোগ তো মানুষের জন‍্য যোগ‍্য ও উপযুক্ত কাজ করার সুযোগ মাত্র। বহু জন্মের পূণ‍্যফলে হয়তো এ সুযোগ পাওয়া। তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এক জন্মের সার্থকতা বটে। উত্তর আমেরিকার প্রতিটি লোক, প্রধানমন্ত্রী থেকে ছোট অফিস কর্মকর্তা পর্যন্ত  এটি বিশ্বাস করেন এবং মানুষকে সম্মান করে সেবা প্রদান করেন। আর এ জন‍্যই তারা এমন সুন্দর, সুখ ও শান্তির নীড় প্রতিটি মানুষের জন‍্য তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন। রাজনীতিতে জনগনকে ভালবেসে, জনগনকে সম্মান প্রদর্শনের বিষয়টি মূখ‍্য।

বর্তমানে দেশে সুস্হ, সুশীল ধারার সংস্কৃতি চর্চা ও এর প্রসার সংকুচিত হয়ে আসছে। ক্ষমতা অপব‍্যবহারের মত বিপদজনক সংস্কৃতি, জীবন ও উন্নয়ন বিমুখী উন্মাদনার সংস্কৃতি এবং  বিচারহীনতার সংস্কৃতি আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে দেশ জুড়ে। যা মানুষের মানসিক গড়নকে বিকৃত করে তোলছে। শিক্ষিত জনেরা নিগৃহীত হচ্ছেন অমানবিকভাবে। কখনো কান ধরে অপমান। কখনো বেত্রাগাতের ভয় প্রদর্শন। আবার  ছাত্রের হাতে হচ্ছেন শিক্ষক খুন। সর্বোপরী আমাদের সংস্কৃতি শিক্ষকের গলায় জুতার মালাতে এসে পৌঁছেছে। সুতরাং সাংস্কৃতিক উন্নয়নের যে শীর্ণ অবস্হা তা সহজেই অনুমেয়। সংস্কৃতি হচ্ছে এমন একটি অনন‍্য সম্পদ যা দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতিধারা নির্ধারণ ও এর উপর সামগ্রিকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ দেশের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের রুপ যেমন হবে উন্নয়নের স্বরুপও সেই রুপ লাভ করবে। সুতরাং হানাহানি, অস্হিরতা, অশান্তির সংস্কৃতি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ শ্রেণীর উন্নয়নকে আদৃত করে। ফলে উন্নয়নের সোনালী স্বপন দিকভ্রান্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে; পথ খুঁজে পায় না। এবার দেখি এ বিষয়ে গুনীজনেরা কি বলেন? নোবেল লরিয়েট অমর্ত‍্য সেনের কথায় “Culture genetates assets such as skills, products, expression and insights that contribute to the social and economic well-being of a community. Both culture and values shape economic development.” সংস্কৃতি হচ্ছে এমন এক মোহনীয় শক্তি যা মানুষের দক্ষতা, সৃজনশীলতা, প্রকাশ ক্ষমতা ও অন্তর দৃষ্টিকে জাগ্রত করে। এই সক্ষমতা সমাজ ও দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মঙ্গল  আনয়নে এক অনন‍্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। মানুষের সংস্কৃতি ও মূল‍্যবোধই অর্থনৈতিক উন্নয়নের আকার, আকৃতি, গতি, প্রকৃতি নির্ধারণ করে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রকাশ কেমন হবে তা সংস্কৃতি ও মূল‍্যবোধের উপর নির্ভর করে।

তাহলে বুঝা যায় উন্নয়ন শুধুমাত্র রাস্তা, ঘাট, দালান, কোটা, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ করা নয়। জীবনমুখী সামাজিক সম্পর্ক ও পরিবেশ বিনির্মাণ, জনগণের প্রতি সমদৃষ্টি সম্পন্ন উন্নয়নমুখী রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রকাশ, সুশীল, সুন্দর, শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং সুশাসনের সংস্কৃতি লালন ও প্রসারই উন্নয়ন। অবকাঠামো উন্নয়ন সিংহভাগই অনুৎপাদনশীল। এ খাতে বেশী বিনিয়োগ হলে দেশের রিজার্ভে ধাক্কা লাগে এবং অর্থনীতি স্হবির হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই এ খাতকে উৎপাদনশীল করার পরিকল্পনা   থাকা উন্নয়নের জন‍্য বাঞ্চনীয়। এ ক্ষেত্রে আকর্ষণীয়  ও নিরাপদ পর্যটন শিল্পের সংযোগ (আভ‍্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যেমন, পদ্মাসেতু ও কর্ণফুলি টানেল অঞ্চলে) স্হাপন করলে অনুৎপাদনশীলতার মাত্রা কমে আসার সম্ভাবনা দেখা দেয়। তাই উন্নয়নের জন‍্য উপরোক্ত বিষয়ে সুন্দর মনোদৃষ্টি ও পরিশীলিত জ্ঞানের প্রয়োজন। অনেক পন্ডিতজনের অভিমত, যে ব‍্যক্তিটি তার ব‍্যক্তিগত জীবনে সুন্দর চিন্তা, মানুষকে সম্মান ও শ্রদ্ধার সংস্কৃতি লালন করেন। সমতা, ন‍্যায‍্য ও সুন্দর সুসাশনে বিশ্বাস করেন। নিরপেক্ষ সুন্দর মানসিকতার অধিকারী। তিনি রাষ্ট্রের কর্ণধার হলেও শত প্রতিকুলতার মধ‍্যে এমন সুন্দরের মধ‍্যেই অবস্হান করবেন। রাষ্ট্রীয় জীবনে তা প্রতিস্হাপনের উদ‍্যোগ নেবেন। যা সুশীল উন্নয়ন ধারা থেকে আরও অগ্রগামী “মানবিক উন্নয়নের” অগ্রযাত্রার দিকে ধাবিত হবে দেশ। যে উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে মানুষ। মানুষের সম্মান, সুরক্ষা ও স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশের জন‍্য সমস্ত আয়োজন। শান্তিপূর্ণ, মুক্তচিন্তার পরিবেশ বিনির্মাণ যা ভীতির সংস্কৃতিকে পেছনে ফেলে স্বপ্রনোদিত, স্বউদ‍্যোগ, মুক্তচিন্তা ও স্বাধীন মননের বিকাশ ঘটায়। মানুষ চিন্তা ও কর্মে স্বাধীনতার মানে খুঁজে পায়। মানুষ পারস্পরিক সম্পর্ক, দায়িত্ব, কর্ম  ও দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। মানুষের সামাজিক সম্পর্কের ভীত মানবিকতার রঙ্গে রঙ্গিন হয়। যে কোন উন্মাদনায় এ সম্পর্ক হারিয়ে যায় না। মানুষ মানুষকে ভালবাসে; দেশকে ভালবাসে। মানুষ মানুষের জন‍্য ও দেশের জন‍্য নিজকে তৈরী করতে শিখে। সকল উন্মাদনা, অস্হিরতা ও অশান্তির বিলুপ্তি ঘটে। আর এ কর্মে যিনি শক্তি যোগান; প্রেরণা যোগান, নেপথ‍্যে সুদৃঢ় ভূমিকা পালন করেন। তিনি হলেন দেশের কর্ণধার। তিনি মানুষের মনে এক চিরস্হায়ী আসন প্রতিষ্টা করেন। তাঁকে মানুষ নিত‍্যকর্মে স্মরণ ও সম্মান করে, তাদের জীবনের শুভ, সুন্দরের স্হপতি হিসাবে। যা তাঁকে নতুন এক ইতিহাসের যাত্রাপথের মহানায়কে পরিনত করে।

মানবিক উন্নয়নের প্রবক্তা বিশ্বনন্দিত গবেষক ও অর্থনীতিবিদ মাহবুব উল হক মানবিক উন্নয়ন সম্পর্কে বলেন “Human development  is defined as the process of enlarging peoples freedoms and opportunities and improving their well-being. People have to decide who to be, what to do and how to live.” মানবিক উন্নয়ন এমন একটি সুন্দর প্রক্রিয়া যা মূলতঃ মানুষের স্বাধীনতার ক্ষেত্র ও শক্তিকে বিকশিত করে;  বিস্তৃত করে। এ শক্তি তার চিন্তার পছন্দ ও অপছন্দের স্বাধীনতা থেকে জীবন ধারণের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেয়। পরিমিত, সুন্দর সুযোগ সুবিধার সৃষ্টি ও বিকাশের পথে অগ্রসর হয়। যা মানুষের জীবনের প্রকৃত মঙ্গল আনয়ন করে এবং  ক্রমাগত এর বৃদ্ধি সাধন করে। মনুষ নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে সমর্থ হবে তার জীবন যাপনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের এবং তারা কেমন মানুষ হতে চায় এবং কোন কর্মে সম্পৃক্ত হতে চায় সে বিষয়ে।

সুন্দর দেশ, সুন্দর জাতি ও সুন্দর মানুষ গড়ে তোলার জন‍্য এই “মানবিক উন্নয়নের” কোন বিকল্প নেই। যারা ক্ষমতায় আছেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা গুলিতে আছেন। তাঁরা একটু চিন্তা করবেন এর আলোকে আমাদের  অবস্হান কোথায় এবং আমাদের কি করনীয়?

অস্হিরতা আর অশান্তি তো আমাদের প্রাত‍্যহিক জীবনের সঙ্গী হয়ে পড়েছে। লোহাগড়ার অনাচার,  অশান্তির বিষয়ে কার্যকরী ও শক্তিশালী পদক্ষেপ না নেয়ার কারণে প্রনোদিত হচ্ছে একদল লোক। যারা উন্মাদনা ছড়িয়ে অন‍্যের সঞ্চিত সম্পদ নিজেরা দখল করতে চায়। ফলে একই ধরনের অশান্তি সৃষ্টির অশুভ শক্তি ছড়িয়ে পড়েছে রাঙ্গুনিয়া, ভোলা, বরিশাল ও হবিগঞ্জে। সব ক্ষেত্রেই মূল বিষয় হিন্দুদের মন্দির ভাংচুর ও জমি, বাড়ী দখল। আতংক সৃষ্টি ও ভয় দেখিয়ে সম্পদ লুটপাট। এসব জায়গায় আক্রমণ ব‍্যাপক রুপ না নিলেও মানুষের মনে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে তা কখনই দূর হবার নয়। এ ট্রমা বড়ই ভয়ংকর। আর কুষ্টিয়ায় তো হিন্দু কলেজ ছাত্রকে বাড়ী থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত‍্যা করা হয়েছে। অপরাধ তার সে নাকী এক মুসলিম মেয়ের সাথে প্রেম করছিল। জানা গেছে বিষয়টি সত‍্যি নয়। আর যদি সত‍্যিও হয় এভাবে একটি নবীণ জীবন কেড়ে নেয়া কি মানুষের কাজ? তাকে অন‍্যভাবে এ কর্ম থেকে বিরত করা যেতো। এমনটি কখনোই হতো না যদি না রাষ্ট্র বিচারহীনতার সংস্কৃতির মোহে আবিষ্ট হয়ে এসব কর্মে প্রনোদনা না দিত। তার মা স্তব্দ হয়ে গেছেন। কাঁদতেও পারছেন না। এসব করুণ আর্তনাদ আপনারদেরকে কি মানুষ হিসাবে একটুও ভাবায় না যারা এর প্রতিবিধান করতে পারেন? না ওরা কি শুধু হিন্দু বলেই ভাবেন না? ওরাও তো মানুষ। এমন কর্মে মানবতা কলংকিত হচ্ছে। বিশ্বময় মানুষ চরমভাবে ঘৃণা করছে আমাদেরকে। যারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গা গুলিতে আছেন, তারা একটু ভেবে দেখবেন এ ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা কি হওয়া উচিৎ ছিল? অনাচার  আর অবিচারে গা ভাসিয়ে দিয়ে দেশকে আর কত কলংকিত করবেন?

একটু লক্ষ‍্য করুন, নিজেদের মধ‍্যে যুদ্ধ করে সর্বস্বান্ত মুসলিম দেশ সিরিয়া। সিরিয়া রিফিউজি যখন বিশ্বব‍্যাপী এক বড় ইস‍‍্যু তখন কানাডা ২০২২সাল পর্যন্ত ৮৫,০০০ সিরিয়ানকে গ্রহণ করে উন্নত জীবন দিয়েছে। একেই বলে মানবতা। এ থেকে আমাদের কিছু শেখা উচিৎ। সুইডেনের ১৪ বছরের মেয়ে সুফিয়া যে বাংলাদেশ সম্পর্কে জানে ও খবর রাখে। এক আলাপচারিতায় সে তো বলেই দিল “তোমার দেশের মন্ত্রীদের আমাদের দেশে এসে শেখা উচিৎ। আমরা সোমালিয়ানসহ কত দেশের প্রায় •৭৫ মিলিয়ন মানুষকে নিয়ে সুন্দরভাবে মিলে মিশে আছি। কেউ কাউকে এখানে ছোট করে দেখে না। কারণ এ পরিবেশ আমাদের রাষ্ট্র তৈরী করেছে। আমরা ঘরে বাইরে সমভাবে নিরাপদ। আমি তন্ময়  হয়ে কথাগুলি শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম একটি ছোট্ট মেয়ে যেভাবে মানুষের কথা ভাবছে, তার বিন্দুমাত্র যদি আমাদের দেশের নীতি নির্ধারকেরা ভাবতেন! তাহলে তো আমাদের দেশ অনেক সুন্দর হতে পারতো।

সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র খুন হয়েছে কিছু উৎশৃঙ্খল অ-ছাত্রদের চুরিকাঘাতে। ক‍্যাম্পাসের পাশে এক নির্জন টিলায় বেড়াতে গিয়েছিল সে। পুত্রশোকে তার মা কান্নাও ভুলে গেছেন। এক্ষেত্রে ও সেই অনাচার আর অস্হির সামাজিক সম্পর্কই দায়ী। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতির অধঃপতনের ফলই এ ঘটনা। ভিসি মহোদয় সহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহোদয়দের বিশ্ববিদ্যালয়ের আশে পাশের লোকেদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন‍্য উদ‍্যোগ নেয়া প্রয়োজন। ক্লাসে পড়ানোর নামই শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা নয়;  আরও  অনেক কিছু। এ ক্ষেত্রে ভারতের ঝাড়খন্ড এর বিরলা ইন্সিটিউট বড় উদাহরণ।

তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সাথে যারা যুক্ত, তাঁদের কাছে অনুরোধ উপরোক্ত বিষয় গুলি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করুন সুন্দর আগামীর জন‍্য। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেড়িয়ে এসে কিছু বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। মানুষকে সর্বাগ্রে সব বিষয়ে স্হান দিয়ে উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করলে দেশের বর্তমান  উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব‍্যাহত থেকে উন্নয়নের মানবিক সোনালী দিগন্তে অবশ‍্যই পৌঁছবে আমার প্রিয় স্বদেশ।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০