ব্রিটেনে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট,  সামনে ভীষণ অন্ধকার..     

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin
অনলাইন অর্ডার মরার উপর খরার ঘা!  
জুয়েল রাজঃ
যুক্তরাজ্যে বাঙালির  ভিত্তিভূমি আমাদের   কারি শিল্প। এই কারি শিল্পকে ভর করেই আজকের ব্রিটিশ বাংলাদেশি  কমিউনিটির  সাফল্যের যাত্রা। যা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট হিসাবে বহুল পরিচিত।
 কিন্তু  কারি শিল্পের রমরমা অবশ্য এক দিনে হয়নি। ব্রিটিশদের মন জয় করতে কারিকেও পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘ  পথ। একটা সময় খোদ ব্রিটিশরাই নাক সিটকাত কারির গন্ধে। নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। আজ ব্রিটিশদের রসনা বিলাসে কারি অপরিহার্য এক নাম। বিলেতে কারির এই অগ্রযাত্রার পুরোভাগে আছেন এবং ছিলেন বাংলাদেশিরাই।
কারি শিল্পের এই শুরু ইতিহাস যতটুকো জানা যায়, ১৮১০ সালে,   লন্ডনের পোর্টম্যান স্কয়ারে দ্য হিন্দুস্তান কফি হাউস নামে একটি রেস্টুরেন্ট চালু হয়। এর মালিক ছিলেন,  ভারতের পাটনা থেকে আসা দীন মোহম্মদ। নামে কফি হাউস থাকলেও মূলত ভারতীয় খাবারই পরিবেশন করা হতো। মূলত  উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটেনে কারি ব্যবসার ব্যাপক প্রসার শুরু হয় বাংলাদেশিদের হাত ধরে। নাজির উদ্দিন নামের এক তরুণ সেই পথচলার এক পথিকৃৎ।   ১৯৩৬ সালে যুক্তরাজ্যে ম্যানচেস্টারে কারি রেস্টুরেন্ট চালু করেন তিনি। সেই থেকেই শুরু…
সরকারী ভাবে বেশ কয়েক বছর ধরেই  বলা হচ্ছে,   যুক্তরাজ্যের ৪ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ডের  কারি শিল্প বর্তমান আছে। যার  মূল নেতৃত্ব   বাংলাদেশিদের হাতে। এই শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে এক লাখ মানুষের। বাঙালি  সম্প্রদায়ের বেকারত্ব ঘুচানোর মূল অবদান এই  রেস্টুরেন্ট ব্যবসার। তারই ধারাবাহিকতায়
১৯৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ক্যাটারার্স অ্যাসোসিয়েশন ইউকে। বলা হয়ে থাকে ব্রিটেনে বাঙালিদের সবচেয়ে প্রাচীন  সংগঠন এটি।  এ তো গেল সোনালী দিনের স্মৃতি চারণ।  কিন্ত সেই সোনালী ইতিহাস দিন দিন মলিন হয়ে যাচ্ছে। কারি শিল্পকে গ্রাস করে নিচ্ছে অন্ধকার। বিশেষ করে করোনা পরবর্তী  কারি শিল্প চলছে  খুড়িয়ে  খুড়িয়ে। করোনা কালীন দীর্ঘ লকডাইন শেষে এক অনিশ্চিত যাত্রা পথে হাঁটছে ব্রিটেনে বাঙালির প্রাণ এই কারি শিল্প।
করোনা কালীন সময়ে সরকার সেবা খাতে বেশ কিছু  সরকারী সাহায্য দিয়েছে, কর্মচারীদের বেতনের একটি অংশ ও দিয়েছে। কিন্ত বাস্তবতা হলো বাংলাদেশি কারি শিল্প  বা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের বাস্তবতা ছিল ভীন্ন। কারণ কর্মীদের  অনেকেই সীমিত সময় কাজ দেখান। যার কারণে ফারলো’র ক্ষেত্রে সরকারী সহায়তা  খুব সামাণ্যই কাজ দিয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে ছোট বা   মাঝারি ধরণের রেস্টুরেন্ট  ব্যবসার দুই তৃতীয়াংশই চলে যায় কর্মচারীদের বেতন।  বাউন্স ব্যাক লোন থেকে ঐ সময় অনেক ব্যবসায়ীই  রেস্টুরেন্টের  ভাড়া সহ ফিক্স ব্যয়গুলো পরিশোধ করেছেন।
করোনা পরবর্তী আবার যখন সব কিছু স্বাভাবিক হওয়া শুরু  করেছে তখনই, কিছু বুঝে উঠার আগেই হঠাৎ  করে বেড়ে গেছে নিত্যপ্রয়োজনীয়  গ্রোসারীর দাম,  চিকেন  প্রতি বক্সে  ১৫ থেকে ২০ পাউন্ড,  সানফ্লাওয়ার  তৈল  টিন প্রতি প্রায় ২০ পাউন্ড বৃদ্ধি পেয়েছে,  এইভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম কম বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি ছোট রেস্টুরেন্টে  যেখানে সাত শত  থেকে আট শত পাউণ্ডে সপ্তাহের ব্যয় মেটানো সম্ভব হত,  সেটি এখন বৃদ্ধি পেয়ে  এক হাজার থেকে ১২ শত পাউণ্ডে উন্নীত হয়েছে, তেমনি ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল  সহ অন্যান্য সেবার দাম । উদাহরণ হিসাবে পাবলিক  লাইভেলেটি  ইন্সুইরেন্স  এর কথা উল্লেখ করা যায়, গত ২০২১ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ও যা ছিল ৬ শ পাউন্ড, ২০২২ সালে সেটি দাড়িয়েছে ১১শ পাউন্ড।  একই ভাবে প্রত্যেকটি খাতেই ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনা কলীন সময়ে কারি ব্যবসার উপর ঝড় বয়ে গেছে,  বহু নামী দামী রেস্টুরেন্টের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এখনো প্রতিনিয়ত বন্ধ হচ্ছে। ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট এবং টেইক ওয়ে গুলো কোন ভাবে মাটি কামড়ে টিকে ছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে  টিকে থাকা  খুবই দুস্কর হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
 মরার উপর খরার ঘা…
কারি শিল্পের এই দুর্দিনে মরার উপর খরার ঘা  হিসাবে আছে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম গুলো। জাস্ট ইট, উবার ইট, ডেলিভারো  জায়ান্ট কোম্পানীর সাথে শত শত ছোট ছোট অনলাইন  মধ্যস্বত্ব ভোগী প্রতিষ্ঠান  গড়ে উঠেছে, যারা কারি শিল্পকে পথে   বসানোর জন্য যথেষ্ট। নীল করের মত অবস্থায় পড়ে গেছেন ব্যবসায়ী গণ। মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে টেইক ওয়ের উপর নির্ভর হয়ে গেছেন ক্রেতাগণ।  ঘরে বসে, চলতি পথে  মোবাইল ফোনে  একটি চাপই যথেষ্ট।  খাবার পৌঁছে যাবে আপনার কাঙ্খিত  গন্তব্যে। বড় বড় এই সব কোম্পানীগুলো বিজ্ঞাপন,  নানা রকম চটকদার অফার,  সহজ অর্ডারিং সিস্টেম সব কিছু দিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে  নিয়ে গেছে। কৈ’ র তেলে কৈ, ভাজার মত কাস্টমারদের  তারা ১০ পাউন্ড ২০ পাউন্ড ছাড় দিচ্ছে।  মূলত রেস্টুরেন্টের কমিশন থেকেই তারা এই ছাড় দিচ্ছে। একজন ক্রেতা যখন দেখেন একই খাবার তিনি রেস্টুরেন্টের  চেয়ে কম টাকায় অনলাইন থেকে নিতে পারছেন তখন তিনি  সরাসরি রেস্টুরেন্টে  অর্ডার না করে,  অনলাইনে চলে যান।
আর এই সুযোগে প্রতিটা ওর্ডারের  কমিশন হিসাবে ৩৪% তারা  নিয়ে নিচ্ছে । যদি তাতেই শেষ হতো হয়তো বা ঠিক ছিল।  ৩৪ % উপর যোগ হচ্ছে  ২০% সরকারী ভ্যাট ( এখন যদিও ১২.৫% এ আছে। একই এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোর মধ্যে প্রতিযোগীতার জন্য আবার রেস্টুরেন্টের  ডিসকাউন্ট  আছে। কেউ ১০ % থেকে ২৫% পর্যন্ত কাস্টমারদের ডিসকাউন্ট দিচ্ছেন।দেখাদেখি গড়ে প্রত্যেক রেস্টুরেন্টই এই ফাঁদে পা দিয়ে ডিসকাউন্ট দিচ্ছেন।  কিন্ত মজার বিষয় হচ্ছে কোম্পানী কিন্ত এই ডিসকাউন্ট  দেয়া অর্থের ও কমিশন, সার্ভিস চার্জ সহ  সব কিছুই কেটে নেয়।
তার মানে ১০০ পাউন্ডের অর্ডারের  মধ্যে  ৬০ থেকে ৭০  পাউন্ড আপনি দিয়ে দিচ্ছেন অনলাইন ওয়ালাদের । এর মাঝেই প্রমোশনাল  হিসাবে নানা রকম ব্যয়।  কিংবা কোন কাস্টমার যদি অভিযোগ করে মানি ব্যাক। সব কিছু মিলিয়ে মাত্র ৩০ থেকে ৩৫ % ব্যাংকে পান একজন ব্যবসায়ী। এই ৩৫% থেকে  যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করতে হচ্ছে। যা মূলত দিন শেষে  পুরোটাই ক্ষতি। রেস্টুরেন্টের  নিজস্ব ওর্ডার এবং টেবিল সার্ভিস বা ডাইনিং  এর কারণে সেই ক্ষতি অনেকেই হিসাবে কষে দেখেন না।  মনে করেন সপ্তাহ শেষে ব্যাংকে এসে একটা  এমাউন্ট জমা হচ্ছে, এইটাই যথেষ্ট!
অনেক ব্যবসায়ী  আবার  অনলাইনে ম্যানুর দাম বাড়িয়ে অনলাইন কোম্পানীর ওয়েবসাইটে  দিয়ে রেখেছেন।  কিন্ত অনলাইন কোম্পানীগুলোর নিয়ম হচ্ছে একই ম্যানু থাকতে হবে। দামের তারতম্য করা যাবে না। কিন্ত অনেক ব্যবসায়ী সেটি মানছেন না বা  এক ধরণের প্রতারণার  আশ্রয় নিয়ে অনলাইন কোম্পানীগুলোর  সাথে যুদ্ধ করছেন।
অনলাইন কোম্পানীগুলোর সাথে কারি শিল্পের নেতাদের কথা বলতে হবে। তাদের কমিশন কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে।।অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা করে ডিসকাউন্ট  দেয়ার  ব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। তবে কোন বিশেষ দিনে বিশেষ অফার দেয়ার ব্যবস্থা রাখা যাবে।অভিযোগ আছে বিসিএ কিংবা কারি এওয়ার্ড এর সাথে যারা জড়িত তাদের অনুষ্ঠানগুলোতে এই সব কোম্পানীগুলো মিলিয়ন পাউন্ড স্পনসর  করে থাকে। যার জন্য কেউ এদের বিপক্ষে বা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের বিপক্ষে  যেতে চান না।
ডজন খানেক কারী এওয়ার্ড  অনুষ্ঠিত  হয় ব্রিটেন জুড়ে। এওয়ার্ড বা ক্রেস্টগুলো   ব্যবসায়ীদের  অবশ্যই সাহায্য করে।  নাহলে দীর্ঘ দিন ধরে এই সব এওয়ার্ড  চলমান থাকতো না।  এবং নতুন নতুন এওয়ার্ডের প্রচলন হতো না। এবং ব্যবসায়ী গণ ও এতে বিপুল ভাবে সাড়া দিতেন না। কারি শিল্পে নেতৃত্বাধীন  এই সব সংগঠন বা এওয়ার্ড  প্রতিষ্ঠানগুলোকে এক কাতারে এসে দাঁড়াতে হবে। লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান,  ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের অস্থিত্ব রক্ষায়, এই খাতে বিশেষ বরাদ্ধের জন্য    সরকারের সাথে আলোচনা করতে হবে। অনলাইন অর্ডার সেবাদান কারি প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে কথা বলে সার্ভিস চার্জ কমিয়ে নিয়ে আসার ববস্থ্যা করতে হবে। এবং অনলাইন গুলোকে  সর্বজনীন একটা নিয়মে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে ডিসকাউন্ট  প্রতিযোগীতা বন্ধ করতে হবে। না হলে ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টের সামনে বিশেষ অন্ধকার। 
বাউল করমের গানের মত গাইতে হবে,
সামনে ভীষণ অন্ধকার করতেছি তাই ভাবনা,গাড়ি চলে না চলে না, চলে না রে গাড়ি চলেনা।
Juyel Raaj
Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০
৩১