যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে সিলেট টাউন ক্লাবের মিলনমেলা অনুষ্ঠিত

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

সুখ দুঃখের স্মৃতি রোমন্থনে ,মিলিত হয়েছিলেন  প্রাণের টানে

 

ইফতেখারুল হক পপলু

 

বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, তাঁতিপাড়া, হাওয়াপাড়া, সুবিদবাজার, সাগরদিঘির পাড়, শিবগঞ্জ কিংবা কলাপাড়া আম্বরখানা, হাউজিং এস্টেট, মজুমদারি কিংবা শাহী ঈদগাহ শহরের সব অলিগলি থেকে স্রোতের মত মানুষ এসে মিশেছিলেন বিলেতের বার্মিংহাম শহরের ব্রডওয়ে একাডেমী হলে। এ যেন এক মায়ায় জড়ানো স্মৃতির প্রিয় বাঁধন। কারে কত বছর যেন দেখছি না হিসাবও মিলাইতাম পাররাম না। ৩৫ বছর পর বন্ধুর সাথে দেখা ! এমনই এক মিলনমেলায় মেতেছিল চৌঠা মে রোববার বার্মিংহাম শহর। সিলেট টাউন মিলনমেলা নামে এমন স্মৃতিকাতর অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল সিলেট টাউন ক্লাব।
সিলেট শহরে শৈশব কৈশোরে বেড়ে ওঠা কিংবা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া এমন শত শত বিলেত প্রবাসী মানুষ স্বপরিবারে অংশ নেন এই মিলনমেলায়। যাদের কাছে সিলেট শহর সুখ কিংবা দুঃখের দিনে একটা আশ্রয়ের নাম। স্বপ্নে মৃদু হাসি কিংবা দীর্ঘশ্বাস হয়ে ছুঁয়ে থাকা প্রিয় শহর সিলেট। এই ছুঁয়ে থাকাকে পরস্পরের সাথে ভাগ করে নেয়ার প্রয়াসে যাত্রা শুরু করে সিলেট টাউন ক্লাব। আর প্রথমবারের মতো সিলেট টাউন ক্লাব এমনই এক মিলনমেলার আয়োজন করে।
মিলনমেলায় আগত কুটুমদের অভ্যর্থনা ,শাহজালালের ওরুস পূর্ব লাকড়ি ভাঙ্গার উৎসব, সিলেটি গান, সিলেটি ধামাইল, দরগাহর প্রবেশদ্বারে সারি সারি দোকানে সাজানো তুষা শিননি কিংবা সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস সবই ছিল এই আয়োজনে। শুধু কি তাই সাথে ছিল নানাজাতের মসলা দিয়ে পান সুপারি, মেহমানদারির আবশ্যিক অংশ চা আর মনিপুরী শাড়ি। আর সিলেট শহরের স্মৃতি নিয়ে প্রকাশিত ম্যাগাজিন সিলেট ৩১০০। ছিল সিলেটি সিলক। ভাগ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে ছিল রেফেল ড্র।


শুধু কি তাই মিলনমেলার সাংস্কৃতিক পর্ব ছিল বিলেতের মাটিতে সেই মফস্বলের সিলেট শহরকে নাচে গানে ধামাইলে তুলে ধরার এক অনবদ্য প্রয়াস। আফসানা সালাম আর ফারহানা মনির অনবদ্য উপস্থাপনায় সাংস্কৃতিক পর্ব আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। জেবতিক রাজিব হক এর চৌকস উপস্থাপনা আর রিসনা হক এর সহযোগিতায় রেফেল ড্রয়ের পর্ব ছিল অনেকটা আমেরিকার ডিবি লাগার প্রতীক্ষার মতো।

সিলেট টাউন ক্লাবের মিলনমেলার সাংস্কৃতিক পর্ব শুরু হয় আমাদের অস্তিত্বের শিকড় জাতীয় সংগীত দিয়ে। সাংস্কৃতিক পর্বে আমরা হক্কল সিলেটি গান আর সাথে ধামাইল হলভর্তি শত শত সিলেটিয়ানদের মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতির সুভাষ চড়ায়। ” সুয়া উড়িলো উড়িলো জীবেরও জীবন ” গানে অর্পিতা দাস নিপার নৃত্য অনুষ্ঠানে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। শিল্পী পথিক চৌধুরী যখন গেয়ে উঠলেন ” সুরমা নদীর তীরে আমার ঠিকানারে বাবা শাহজালালের দেশ সিলেট ভূমিরে ” যেন হলভর্তি দর্শকের হৃদয় চুয়ে গেল সিলেটি মায়ায়।‌ এরপর শতরূপা চৌধুরী যখন গাইলেন ” আমি সাধ করে পড়েছি গলে শ্যাম কলঙ্কের মালা ” হলভর্তী দর্শক তখন তার সাথে ধামাইলে অংশ নেন। আর তখন হৃদয় ছোঁয়া আবেগে পুরো হল জুড়ে এক ভিন্ন আবহের সৃষ্টি হয়। ” কত মনে কত কথা হৃদয়ে মোর আছে গাঁথা, আমার সাদা দিলে কাদা লাগাই গেলিরে বন্ধু ” শিল্পী রাহেল চৌধুরীর এমনি গানে মফস্বলের সিলেট শহরের অতীত স্মৃতিগুলো মুহূর্তের মধ্যে জীবন্ত হয়ে উঠলো সবার মাঝে। অয়ন পাল যখন গাইলেন ” কেন এই পিঞ্জিরাতে তোমার বসতি কেন এই পিঞ্জিরার সঙ্গে তোমার পিরিতি” মনে হল এই পিঞ্জিরাই হচ্ছে সিলেট আর সিলেটের মোহে সবাই এই দূর প্রবাসেও আবদ্ধ।‌। একই সাথে অয়ন পাল মনের মাধুরী মিশি আরো গাইলেন ” স্বয়নে স্বপনে দেখি আসিল এক বুজুর্গ, রাস্তার মাঝে কত লোকে করিতেছে সন্ধান দিল্লিতে ফিরে এলো নিজাম উদ্দিন আউলিয়া “। এ যেন অলি আউলিয়ার শহর সিলেট কে মনে করিয়ে দিল আরেকবার। শুধুই কি সিলেটি গান সেই ৯০ দশকের আমাদের সবার হৃদয় জাগানো ব্যান্ডের গান গাইলেন রেজওয়ান। সেই তুমি কেন এত অচেনা হলে , কবিতা তুমি স্বপ্নচারিনী হয়ে খবর নিও না, কিংবা পাগলা হাওয়ার তরে এমন গানে কার না মোহভঙ্গ ঘটে বলেন। পুরো হলের দর্শক তখন রেজোয়ান এর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে ফিরে গেলেন তাদের সেই দুরন্ত শৈশব কৈশোর আর শিক্ষাজীবনে। প্রান্তিক চত্ত্বর, জর্জের টিলা কিংবা এম সি কলেজ ক্যাম্পাসে। ” তুমি সুজন কান্ডারী মাঝি সাবধানে চালাও মহাজনে বানাইয়াছে ময়ূরপঙ্খী নাও ” অয়ন পালের এমন গানে সত্যিই সবাইকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল সেই সুরমা তীরে চাঁদনীঘাটের সিঁড়ির কাছে। আর পথিক চৌধুরীর পিরিতের গান ” সাদাসাদা কালা কালা গানে ধামাইল ছিল অপূর্ব। আবৃত্তিতে অংশ নেন শশী, জিয়াউর রহমান সাকলাইন, সুপ্রিয় দেব শান্ত। সময় গড়িয়ে যায় কিন্তু গানের মোহ আর স্মৃতির রেশ যেন কাটতে চায় না। তারপরও হলরুমে সময়ের সীমাবদ্ধতাহেতু অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়। অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সংগীত দিয়ে আর সাংস্কৃতিক পর্বের ইতি ঘটে দুনিয়া জুড়ে সিলেটের অস্তিত্ব জানান দেয়া গান ” সুরমা গাঙ্গোর পাড় বাড়ি শাহজালাল এর উত্তরসূরী দেশ-বিদেশে বেটা গিরি আমরা হক্কল সিলেটি ” গান আর সাথে ধামাইল দিয়ে।

সিলেট টাউন ক্লাবের এমন স্মৃতি জাগানিয়া অনুষ্ঠানকে সফল করে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখে বেশ কটি প্রতিষ্ঠান। তারমধ্যে
উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কার্নিভাল ইন্টারনেট, সোনালী পে, আলিফ এন্ড কো, এডিসি আর আর সৃজনশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন পূর্বনাট।

অনুষ্ঠানের আড়ালে ও ধরাছোঁয়ার বাইরে বায়বীয় হয়ে যারা অগ্রজ ছিলেন তারা হলেন গোলাম মোস্তফা চৌধুরী যুবরাজ, আব্দুল মালিক পারভেজ, আতিফ টুটুল হোসেইন, শাকিল আহমেদ, আরিফ চৌধুরী, জেসমিন চৌধুরী, ব্যারিস্টার আবু সাদাত সায়েম, ফয়েজ আহমেদ খান, শামসুর চৌধুরী মুরাদ, হেদায়েতুল ইসলাম রোজেন, আবু সায়িদ রাসেল, তামিম সিদ্দিকী, কামাল আহমেদ, আশফাক চৌধুরী, এ বি রাহাত প্রমূখ ।

বিশাল এই মিলনমেলার কো-অর্ডিনেটর ছিলেন জেবতিক রাজিব হক। ফাইনান্স এন্ড রেজিস্ট্রেশন এর দায়িত্বে ছিলেন সাইফুল ইসলাম শাহেদ ও রাজিব মহিউদ্দিন। প্রমোশনের দায়িত্বে ছিলেন মুরাদ খান, জাকি চৌধুরী, মাযদুস সোবাহান রনটি।
লজিস্টিক এন্ড ভ্যানু ম্যানেজমেন্ট এ ছিলেন গোলাম মোস্তফা লিমন, অমিত বিক্রম দেব, অয়ন পাল, রিসনা হক, নাশমা ইসলাম, রওশন আরা ইমন, আফরিন মহিউদ্দিন। ফুড এন্ড রিফ্রেশমেন্ট এর দায়িত্বে ছিলেন আবু হায়দার চৌধুরী সুইট, শরিফ রাজ্জাক হীরা, সুপ্রিয় দেব পুরকায়স্থ। কালচারাল প্রেজেন্টেশনের দায়িত্বে ছিলেন তাহসিন চৌধুরী, জিয়াউর রহমান সাকলেন, ফারহানা মনি, আফসানা সালাম, শতরূপা চৌধুরী।
পাবলিকেশন এডিটোরিয়াল বোর্ডে ছিলেন রানা মেহের, মোহাম্মদ মারুফ, নজমুল আলবাব, আতিকুর রহমান। ডিজাইনে ছিলেন সিলেট থেকে অরুপ বাউল। পুরো সাউন্ড সিস্টেমে কাজ করেছেন ওয়ালি, ফাহিম, রেজওয়ান, রোহিত প্রমুখ।

মফস্বলের সেই ছোট্ট সিলেট শহর আর আজকের আধুনিক সিলেট শহরের বিস্তর ফারাক। সব ছড়া,দীঘি হারিয়ে গেছে। কিন্তু স্মৃতিতে রয়ে গেছে সেই সিলেট শহর। সেই শহরে একদিন যারা হাসতেন, চলতেন, খেলতেন, ফিরতেন, পড়তেন তারা আজ দূর প্রবাসী। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় সবাই ছিটকে পড়েছেন বহুদিন থেকে। ইন্দ্রজালিক যোগাযোগ থাকলেও সরাসরি দেখা হয় না বহুজনের সাথে বহুদিন। বহু বছর পর প্রথমবারের মতো সিলেট টাউন ক্লাবের এই মিলন মেলা সবাইকে সরাসরি দেখা হওয়ার, কথা বলার, একসাথে চা কিংবা জিলাপি তুশা শিন্নি খাওয়ার সুযোগ করে দিল। মিলনমেলার মূল্যায়নে ব্লগার অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আরিফ জেবতিক বলেন আসলে পুরো সিলেট শহরটাই এক সময় ছিল একটি পরিবার। আজ এই পরিবারের মিলনমেলা হল। সায়েম চৌধুরী বলেন আসলে স্মৃতির কাছে ফিরে যাওয়া। আর এ কারণেই সিলেট টাউন ক্লাবের এই মিলনমেলা তাৎপর্যপূর্ণ। ইমরান আহমদ এর মতে সিলেট টাউন ক্লাবের এই মিলনমেলায় এসে একখন্ড সিলেট কে খুজে পেয়েছি । আফসানা সালাম বলেন এই মিলনমেলায় যুক্ত হতে পেরে মনে হয়েছে আমরা সেই ছোট্ট বেলায় ফিরে গিয়েছি। আতিকুর রহমান বলেন আসলে সিলেট শহর আমাদের প্রাণের। প্রেম ভালোবাসার শহর সিলেট। জেসমিন চৌধুরীর বলেন আসলে কারে কত বছর যে দেখছি না তার হিসাব মেলাতে পারছি না। তার মধ্যে সিলেট টাউন ক্লাবের আজকের এই মিলনমেলা না হলে হয়তো জীবনে আর অনেকের সাথে দেখাও হতো না। তাইতো মিলন মেলাকে বহু বছর বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান অনুষ্ঠানে আগত সবার। অবশ্য মিলনমেলার কোঅর্ডিনেটর জেবতিক রাজিব হক এবছর মিলনমেলায় যারা যুক্ত হয়েছেন তাদের সবাইকে অভিনন্দন জানান। একই সাথে যারা যুক্ত হতে পারেননি তাদেরকে নিয়ে আগামী বছর বড় সড় পরিসরে মিলনমেলা আয়োজনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন
আড্ডা গান স্মৃতিচারণে কখন যে দিন চলে গেছে কেউ টের পাননি। অবশেষে গোধূলি লগ্নে মিলনমেলায় আগতদের সবাই তাদের প্রিয় শিকড় সিলেট, প্রিয় মাটি, প্রিয় স্বদেশ ভালো থাকুক এই প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে গেছেন যার যার গন্তব্যে। আগামীর কোন এক সময় আরেকবার সবাই মিলিত হবেন প্রানের টানে, প্রিয় শহর সিলেটের টানে।। কেননা সবার গন্তব্য যে সিলেট ৩১০০।

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০