ইউনুসের বাধায় নতুন রূপে ফিরলেন বঙ্গবন্ধু

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

এফ এম শাহীন

১৫ আগস্ট, কালো সেই দিন। জাতির ইতিহাসের শোকের দিন। বাঙালির হৃদয়ে বেদনাভারী অক্ষরে লেখা এই তারিখের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ড। দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে মানুষ তাঁকে স্মরণ করেছে ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়। কিন্তু ২০২৫-এর এই শোক দিবস যেন ইতিহাসের এক অভাবনীয় বাঁক—যখন একটি অবৈধ সরকার, নিজেদের ক্ষমতার জোরে মানুষের মৌলিক অধিকার -শোক প্রকাশের অধিকার কেড়ে নিল।

ইউনুসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এদিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের পথে মানুষের প্রবেশে বাধা দেয়। যেন জাতির পিতাকে ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধা জানানো অপরাধ। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী থাকবে—কোনও শাসকের লাঠি, বন্দুক, কিংবা মবের তাণ্ডব কখনও মানুষের হৃদয়ের ভালোবাসাকে থামাতে পারে না।

* রিকশা শ্রমিক আজিজুল। প্রতিদিনের আয় দিয়ে সংসার চালান, বাচ্চার পড়াশোনা, স্ত্রীর ওষুধ। তবু আজ ১৫ আগস্ট তিনি সারাদিনের কষ্টার্জিত আয় থেকে একটি বড় অংশ জমিয়ে রেখেছিলেন ফুল কেনার জন্য। স্বপ্ন ছিল, ধানমন্ডি ৩২-এ গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাবেন। কিন্তু পথে এসে দাঁড়াল শাসকের মব বাহিনী। বাঁধা পেলেন তিনি। ফুল হাতে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে পারেননি।

তবু তাঁর অশ্রুসজল চোখ, বুকের ভেতর থেকে আসা আহাজারি এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি অনাবিল ভালোবাসা বাংলাদেশের কোটি শ্রমজীবী মানুষের মনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলো। আজিজুলের এই আত্মত্যাগ যেন প্রমাণ করে দিলো- বঙ্গবন্ধু কোনো দল, গোষ্ঠী বা রাজনীতির সীমানায় বন্দি নন। তিনি শ্রমজীবী মানুষের পিতা, দরিদ্রের আশ্রয়, বাঙালির আত্মার প্রতীক।

* সেদিন আরেকটি দৃশ্য সারা দেশের মানুষের হৃদয় কাঁপিয়ে দিলো। এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। হাতে ছোট্ট দুটি ফুল। তাঁর স্বপ্ন ছিল শহীদের উত্তরসূরী হয়ে, শহীদের রক্তের ঋণ শোধ করতে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাবেন। কিন্তু ইউনুসের মব তাঁকেও ঢুকতে দিলোনা।

ক্যামেরায় ধরা পড়ল তাঁর চোখের জল, বুকে চাপা কান্না, আর আকাশের দিকে তাকিয়ে উচ্চারিত আর্তি—“হায়! আমি জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না।” এই দৃশ্য কোটি মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেল। যারা টেলিভিশন, ফেসবুক বা মোবাইলের পর্দায় তা দেখেছিল, তাদের চোখে পানি এসে গিয়েছিল। যেন বাঙালি জাতির প্রতিটি সন্তান তাঁর সঙ্গে একসাথে কাঁদল।

* শুধু শহীদ পরিবার নয়—এদিন একজন ধর্মপ্রাণ মাওলানা পিরোজপুর থেকে বউ-বাচ্চাসহ এসেছিলেন ধানমন্ডি ৩২-এ। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল খুব সরল—বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করা। কিন্তু তাকেও বাধা দিল মব। উত্তেজিত হয়ে তিনি চিৎকার করে উঠলেন—“একজন মুসলিম হয়ে আরেকজন মুসলিমের রুহের মাগফিরাত কামনা করা কি অন্যায়? দোয়া করা কি পাপ?”

এই প্রশ্ন যেন পুরো জাতিকে নাড়া দিল। ধর্ম, রাজনীতি কিংবা ক্ষমতা। সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে একজন মুসলিম আরেকজন মুসলিমের জন্য প্রার্থনা করতে চাইছেন, আর তাকে বাধা দেয়া হচ্ছে! এর চেয়ে ভয়াবহ অন্যায় আর কী হতে পারে?

* ইউনুস সরকার ভেবেছিল, বাধা দিলে মানুষ ভয় পাবে। কিন্তু ঘটল উল্টো। শোক দিবসে ধানমন্ডি ৩২-এ লাখো মানুষের ভিড় না জমলেও, কোটি মানুষের মন ভরে গেল বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায়।

ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম—সব জায়গায় ঝড় উঠলো। মানুষ নিজ নিজ ঘরে, স্কুলে, দোকানে, এমনকি গ্রামে-গঞ্জে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিল। হাজারো মানুষ নিজের হাতে বানানো কার্ড, কবিতা, ছবি পোস্ট করলো। সারা দেশের সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন শোক ও শ্রদ্ধার জোয়ার এর আগে আর কখনো দেখা যায়নি।

এ যেন ৫৪ বছরে নজিরবিহীন এক ভালোবাসার বিস্ফোরণ। এমনকি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে কোটি টাকা খরচ করে যেসব আয়োজন করা হতো, তাতেও সাধারণ মানুষের হৃদয় এত গভীরভাবে নাড়া খায়নি। কিন্তু ইউনুস সরকারের এই নিষেধাজ্ঞা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনলো নতুন রূপে, নতুন ভালোবাসায়।

* আজ ইতিহাস সাক্ষ‍্য দিচ্ছে যে, বঙ্গবন্ধুকে এক লোভী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে বন্দি করতে চেয়েছিল, আজ তিনি মুক্ত হয়ে আবার ফিরে এসেছেন মানুষের হৃদয়ে। তিনি আর কেবল কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা নন, তিনি হয়ে উঠেছেন সার্বজনীন—বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আশ্রয়।

মানুষ আজ তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করছে—একজন পিতা হিসেবে, একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে, একজন ত্যাগী নেতা হিসেবে। আজ রিকশাওয়ালা আজিজুল থেকে শুরু করে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী, গ্রামের মাওলানা থেকে শহরের ছাত্রসবাই তাঁর মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাচ্ছে।

লাখো কোটি বাঙালি বিশ্বাস করছে—বঙ্গবন্ধু আকাশ থেকে সবকিছু দেখছেন। তিনি দেখছেন তাঁর সন্তানের চোখের জল, অশ্রুসিক্ত ভক্তির নিদর্শন, আর অন্তরের গভীর থেকে আসা ভালোবাসা। আর তিনি নিশ্চয়ই হাসছেন—কারণ জানেন, তাঁর বীজ রোপণ করা স্বাধীনতার স্বপ্ন কখনও মুছে যাবে না। তিনি হাসছেন, কারণ মানুষ আবার জেগে উঠছে। তিনি হাসছেন, কারণ বাধা দিয়েই মানুষ তাঁর ভালোবাসাকে আরো দৃঢ় করেছে।

আজকের এই ঘটনা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়ে গেল। কোনো শাসকই ইতিহাসের ওপরে উঠতে পারে না। কোনো শক্তিই মানুষের হৃদয়কে বন্দি করতে পারে না। শাসকরা ফুলের তোড়া থামাতে পারে, মোনাজাতের শব্দ বন্ধ করতে পারে, কিন্তু মানুষের চোখের জল, বুকের ভালোবাসা, হৃদয়ের শ্রদ্ধা কোনোদিন আটকাতে পারবে না।

এই শোক দিবস আমাদের মনে করিয়ে দিলো -বঙ্গবন্ধু কেবল অতীত নন, তিনি বর্তমান, তিনি ভবিষ্যৎ। তাঁর রক্ত, তাঁর ত্যাগ, তাঁর স্বপ্ন আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত।

ইউনুস সরকার ১৫ আগস্ট শোক দিবসে মানুষকে বাধা দিয়ে ভেবেছিল বঙ্গবন্ধুকে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে পারবে। কিন্তু আসলে তারা যা করেছে, তা হলো উল্টো। তারা সাধারণ মানুষের হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর পুনর্জন্ম ঘটিয়েছে।

আজ বঙ্গবন্ধু নতুন রূপে ফিরেছেন—শ্রমজীবী মানুষের ভালোবাসায়, শহীদ পরিবারের অশ্রুতে, ধর্মপ্রাণ মানুষের দোয়ায়, আর কোটি সন্তানের নিঃশব্দ শোকে।

এই হলো ইতিহাসের নির্মম কিন্তু সত্য শিক্ষা—কেউ শোকের অধিকার কেড়ে নিতে পারে না। আর যাকে মানুষ হৃদয়ে বহন করে, তাকে হত্যা করা যায় না, তাকে মুছে ফেলা যায় না।

আজ আবার প্রমাণ হলো—বঙ্গবন্ধু মুজিব কেবল একটি নাম নয়, তিনি একটি ইতিহাস। যা পাতায় পাতায় অবস্থান করছেন, একটি দেশের অপর নামে চিনে নেয় বিশ্ব , শোষিত শ্রমিক-কৃষকের আশ্রয় ও ভালোবাসার মনমন্দিরে তাঁর আসন। বঙ্গবন্ধু, তুমি ফিরেছো
শ্রমিকের অশ্রুতে, শহীদের কণ্ঠে,
প্রার্থনার ধ্বনি, সন্তানের ভালোবাসায়, তুমি আছো, বাঙালির অনন্ত সত্তায়।

—এফ এম শাহীন, (১৮ আগস্ট, ২০২৫)
চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মী
সদস্য সচিব, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭৩০৩১