অভিষেক জিকু –
গ্রামবাংলায় প্রচলিত, ‘নিজে পায়না জায়গা, কুত্তা আনে বাঘা’। পাকিস্তানের অবস্থাটাও এখন অনেকটাই সেইরকম। নিজেরাই দেউলিয়া, তীর্থের কাকের মতো তাকিয়ে বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তার দিকে! আবার তাঁরাই নাকি শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনুসের ভরসাস্থল! অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাই একাত্তরে গণহত্যা ভুলে পাকিস্তানের সঙ্গে গলাগলিতে ব্যস্ত। মৌলবাদীদের হাতের পুতুলদের ভরসা এই ডুবন্ত জাহাজ। ফলে বাংলাদেশের সামনে কি বিপদ অপেক্ষা করছে কেউ জানেনা।
খাদের কিনা থেকে বাঁচতে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আরও ৪০ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা চেয়েছে পাকিস্তান। সেই অর্থই তাদের শেষ ভরসা। সরকারি খাতে ২০ বিলিয়ন ডলার এবং বেসরকারি খাতে বাকি ২০ বিলিয়ন ডলার তাদের চাইই। নইলে নিজেরাই আগামী দিনে খেতে পাবে কিনা সেটাই বড় প্রশ্ন। তবু তাদের ওপরই ভরসা ড. ইউনূস সরকারের। তাই ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতি এবং তিন লাখেরও বেশি বীরঙ্গনার আত্মত্যাগ ভুলে পাকিস্তানের জন্য লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একাত্তরের গণহত্যার জন্য ক্ষমা না চাইলেও তাদের প্রশংসা করছেন বর্তমান সরকার । মৌলবাদীদের নিয়ন্ত্রিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসলে দেশে সার্বভৌমত্বও জিম্মি রাখতে চলেছে। তাই সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তাদের পাঠানো হয়েছে ইসলামাবাদ সফরে।
একাত্তরের গণহত্যার জন্য এখনও ক্ষমা চায়নি পাকিস্তান। তবু বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামর-উল-হাসান প্রশংসা করে এলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্বের। শোনা যায়
অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফর করেন। সেখানে তিনি পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের আত্মত্যাগের জন্য গভীর প্রশংসা করেন। একবারও তার মনে পড়েনি একাত্তরে খান সেনার অমানবিক অত্যাচারের কথা! প্রতিনিধি দলটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির এবং জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির (সিজেসিএসসি) চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সঙ্গেও বৈঠক করে। পাকিস্তানি সেনাপ্রধান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান দ্বিপক্ষীয় সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। পাকিস্তানের সেনাকর্তারা ‘শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সম্পর্ক ‘গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেন। বৈঠকে জেনারেল মির্জা ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান আঞ্চলিক ‘শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা’ এবং উন্নয়নের জন্য সহযোগিতার ‘জরুরি প্রয়োজনের’ বিষয়ে একমত হন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন পাকিস্তানের কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে চাইছে। অথচ পাকিস্তান নিজেই নিজেদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিতি পেতে চলেছে। জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে তারা নিজেই আজ জঙ্গিবাদের বড় শিকার। এখন তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ইসলামিক জঙ্গিবাদ আমদানি করার আশঙ্কা বাড়ছে বাংলাদেশে।
পাকিস্তানের বহু মানুষ এখন দুবেলা ঠিকমতো খেতে পান না। আর সেই পাকিস্তান থেকে চাল আমদানি করে ড. ইউনূসের সরকার বাংলাদেশের মানুষের মুখে অন্ন জোগানোর স্বপ্ন ফেরি করছেন। ১৪ জানুয়ারি ট্রেডিং কর্পোরেশন অফ পাকিস্তানের চেয়ারম্যান সৈয়দ রাফিও বশির শাহ এবং বাংলাদেশের খাদ্য দপ্তরের মহাপরিচালক মোঃ আব্দুল খালেক পাকিস্তান থেকে চাল আমদানির বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। সমঝোতা চুক্তির সময় ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত সৈয়দ আহমেদ মারুফ, পাকিস্তানের বাণিজ্য দপ্তরের বিশেষ সচিব শাকিল আহমেদ মংনেজো, বাংলাদেশের খাদ্য সচিব মোঃ মাসুদুল হাসান উপস্থিত ছিলেন। পরে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদারের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ শাহবাজ শরীফের পক্ষ থেকে চাল উপহার দেন। আসলে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে ইসলামাবাদ এখন বাংলাদেশের এই অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলকে বেছে নিয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে বলে অনেকেরই আশঙ্কা।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ সম্প্রতি নিজেই নিজের দেশের শিক্ষার বেহাল দশার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানে ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী ২ কোটি ২৮ লাখ শিশু এখনো স্কুলের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত’। অথচ, সেই পাকিস্তানের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুজুরি কমিশনকে (ইউজিসি) সরকারি খরচে ইসলামাবাদ পাঠানো হয়েছে। ১৩ থেকে ১৬ ডানুয়ারি ‘প্রমোটিং সাউথ এশিয়ান রিজিওনাল কোঅপারেশন ইন হায়ার এডুকেশন কনফারেন্সে ‘যোগ দিতে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজের নেতৃত্বে ৯ জনের একটি প্রতিনিধি দলকে পাঠানো হয় ইসলামাবাদে। যে পাকিস্তান বাঙালির মেধাকে ধ্বংস করতে একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বর্বরোচিত হামলা চালায় তারাই নাকি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে সহযোগিতা করবে!
ইতিমধ্যেই পাকিস্তানি জাহাজকে বাংলাদেশে নোঙর করার সুবিধা দিতে শুরু করেছে। দুই দেশই ভিসা ব্যবস্থা আরও শিথিল করছে। সরাসরি বিমানও চলবে ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে। ফলে বাড়ছে জঙ্গিবাদীদের অনুপ্রবেশের পাশাপাশি অস্ত্র ও মাদক চোরাকারবার বৃদ্ধির আশঙ্কাও।
আসলে বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগাতে চাইছে পাকিস্তান। তাই সম্পর্ক উন্নয়নের নামে তারা চাইছে আধিপত্য বিস্তার করতে। বাণিজ্য প্রসারের নামে ব্রিটিশরা যেভাবে অবিভক্ত ভারত দখল নিয়েছিল, ঠিক সেই কৌশলেই পাকিস্তানও তাদের হারানো জমি ফিরে পেতে মরিয়া। তাই ১২ বছর পর সেদেশের বণিক সভা বাংলাদেশ সফর করে। জয়েন্ট বিজনেস কাউন্সিল বা যৌথ ব্যবসা পরিষদ গঠনে সমঝোতা স্মারকেও স্বাক্ষর করেছে দুই দেশ।
পাকিস্তানের ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (পিএফপিসিসিআই) এবং বাংলাদেশের ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ঢাকায় এই সমঝোতা স্মারকে (এমওইউ) সই করেন। এফপিসিসিআই সভাপতি আতিফ ইকরাম শেখের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধিদল ঢাকায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান বিজনেস ফোরামে অংশ নিতে এসেছিলেন।
পিএফবিসিসিআই প্রশাসক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন তাদের জানান, বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তানিদের ভিসার শর্ত শিথিল করেছে এবং পাকিস্তানও একই ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে।
বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির (বিডা) সঙ্গেও পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলটির বৈঠক হয়। তাদের সম্মানে পাকিস্তানি দূতাবাসে নৈশভোজ দেন রাষ্ট্রদূত জনাব সৈয়দ আহমেদ মারুফ। সেখা পিএফপিসিসিআই সভাপতি আতিফ ইকরাম শেখ, পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব শাকিল আহমেদ, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অতিরিক্ত সচিব নাবিদ শফিউল্লাহ প্রমুখকে একান্তে কথা বলতেও দেখা গিয়েছে। জানা গিয়েছে, ঢাকার বাণিজ্য মেলা পাকিস্তানকে স্বাগত জানানো হয়েছে। সবমিলিয়ে পাকিস্তানকে খুশি করার চেষ্টা চলছে সর্বত্র।
কিন্তু ঋণের দায়ে জর্জরিত চূড়ান্ত অস্থিতিশীল অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড ও জঙ্গিবাদের পীঠ স্থান পাকিস্তানের সঙ্গে ভাব করে বাংলাদেশের কী লাভ সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ৩০ লাখ শহীদের বাংলাদেশের মানুষ পাকিস্তানের সঙ্গে এই সখ্যতা মেনে নেবেন? সেটাও আজ বড় প্রশ্ন। সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে মৌলবাদীদের দোসর ড. ইউনূস ও তার উপদেষ্টারা দেশের সার্বভৌমত্ব জিম্মি দিচ্ছে না তো?