বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বর্বরোচিত ও কলঙ্কিত একটি দিন ২১ আগস্ট

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

মাহবুবউল আলম হানিফ:

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বর্বরোচিত ও কলঙ্কিত একটি দিন ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের এই দিনে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সুস্পষ্ট মদদে ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত দলের মিছিলপূর্ব সমাবেশে ঘটানো হয়েছিলো ইতিহাসের ভয়ঙ্করতম নারকীয় গ্রেনেড হামলা। দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করার জঘন্য অপচেষ্টার দিন ২১ শে আগস্ট। সৌভাগ্যের সারথিরূপে সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা।

ক্ষমতার লোভ ও হত্যাযজ্ঞের ওপর ভিত্তি করে বিএনপি প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। সেই দলটি আজও ক্ষমতা দখল ও নোংরা রাজনীতির খেলায় মেতে রয়েছে। দলটি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে ধ্বংস করে দিতে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অপকৌশল প্রয়োগের সময় হিসেবে বার বার বেছে নিয়েছে আগস্ট মাসকে। ২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট তেমনি একটি দিন। এদেশে স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করার জন্য নোংরা রাজনীতির জন্ম দেয় কালো অধ্যায়।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে চালানো নারকীয় এ হামলায় মলিন হয়ে গিয়েছিলো বাংলা ও বাঙালির মুখ। ঘাতকদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড যদি ট্রাকের মঞ্চের ওপর বিস্ফোরিত হতো, তাহলে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কোনো সিনিয়র নেতাই প্রাণে রক্ষা পেতেন না। আর এটাই ছিল ঘাতকচক্রের মূল পরিকল্পনা।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে ভিন্ন আদর্শ ও ভিন্নমত থাকবে। সেই মত জনমুখী করতে রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তা তুলে ধরবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো দলকে নিশ্চিহ্ন করা বা দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার ষড়যন্ত্র কোনো সভ্যসমাজে কাম্য হতে পারে না। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া যে এ ধরনের হামলা সম্ভব নয়, তা-ও এখন স্পষ্ট। পরবর্তী সময়ে এই মামলায় দেয়া সাক্ষ্যই তা প্রমাণে যথেষ্ঠ।

এই ভয়াবহ এবং নৃশংস হামলার পেছনে বিএনপি- জামায়াত জোট সরকারের সরাসরি জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রমাণ :

১. গ্রেনেড হামলার পরপরই হতাহতদের উদ্ধার না করে আক্রমণকারীদের রক্ষা করার জন্য সেদিন সেই ভয়াবহতার মধ্যেই পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস ছুড়েছে। সব আলামত সিটি করপোরেশনের গাড়ি দিয়ে ধুয়ে নষ্ট করা হয়েছে। একটা গ্রেনেড অবিস্ফোরিত ছিল, সেটি সংরক্ষণের কথা বলায় একজন অফিসারকে ধমকানো হয়। পরে তাঁকে নির্যাতনও করা হয়। এবং পরবর্তীতে সেই গ্রেনেড নষ্ট করে দেওয়া হয়, আলামত হিসেবে রাখা হয়নি।

২. ঘটনার পরদিন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আব্দুল জলিলসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দের একটি টিম থানায় মামলা করতে যান তখন একবার মতিঝিল, আরেকবার রমনা এভাবে করে ঘুরিয়ে তিন ঘন্টারও অধিক সময় রমনা ও মতিঝিল থানায় বসিয়ে রেখেও মামলা নেয়নি পুলিশ।

৩. বিএনপির পক্ষ থেকে একটা মিথ‍্যাচারের নাটক শুরু করা হয়। তারা বলা শুরু করে যে সমাবেশটি হওয়ার কথা ছিল মুক্তাঙ্গনে। সেটিকে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে সরিয়ে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে নিয়ে গেছে তারমানে এটার পেছনে কোনো রহস‍্য আছে। অথচ এই জনসভার তিন দিন আগে থেকেই স্থান হিসেবে ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এর নাম ঘোষণা করা হয়েছিলো। এমনকি তিন দিন আগেকার এবং ঐ দিনের সকল প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকায় এটি বিজ্ঞাপন আকারে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিলো। তারপরও বিএনপি এটা নিয়ে মিথ্যাচার করে, বিভ্রান্তি ছড়িয়ে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ তৈরি করার যে অপচেষ্টাটি করে তাতেই সন্দেহের তীর বিএনপির দিকেই যায়।

৪. পরে মামলা করে যে জজমিয়া নাটক সাজানো হলো। এতবড় ঘটনা যেখানে বিরোধী দলের নেত্রীর উপর হামলা হলো। ২৪ জন মানুষ শহীদ হলেন, ৫০০ জন গুরুতর আহত হলেন। এতবড় মর্মান্তিক ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা না করে জজমিয়া নাটক করে মামলাটিকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছে বিএনপি- জামাত জোট সরকার। কাদেরকে রক্ষা করার জন‍্য ?

৫. এই মামলার পর এক সদস্যের একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয় বিচারপতি জয়নাল আবেদীনকে দিয়ে। তিনি এসেই প্রথমদিনই বলেন -এই হামলায় বাইরের হাত আছে। একদিকে সরকার করছে জজমিয়া নাটক অন‍্যদিকে সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশন বলছে হামলার পেছনে ওপারের গোয়েন্দা সংস্থার হাত আছে। সরাসরি ভারতকে দোষারোপ করেছে।

৬. এফবিআই এর তদন্ত দলকে সহযোগিতা না করার মতো অন্যায় কাজ করেছিলো সরকার।

৭. এই ব‍্যাপক প্রাণহানি এবং হতাহতের ঘটনায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যখন সংসদে শোক প্রস্তাব দিতে চাওয়া হলো তখন সেটা প্রত্যাখ্যান করা হলো। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা কথা বলতে চাইলে তাদের কোনো মাইক দেওয়া হলো না। খালেদা জিয়া নিজেই দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওনাকে আবার কে মারবে। উনি তো ভ্যানিটি ব্যাগে করে নিজেই গ্রেনেড নিয়ে সেখানে গেছেন এবং নিজেই গ্রেনেড মেরেছেন।

এইসব ঘটনা গুলোই প্রমাণ করে সরকার এই হামলায় সরাসরি জড়িত ছিল। তা না হলে সরকার কেন এতবড় ন‍্যাক্কারজনক ঘটনাটিকে শুরু থেকেই ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছে। এবং কেন তারা এই সমস্ত মিথ‍্যাচারের আশ্রয় নিয়েছে ?

পরবর্তীতে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই ঘটনার তদন্ত করে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করে দুটি পৃথক মামলা করে। ২০০৯ সালে আদালত এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয়। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১১ সালের ৩ রা জুলাই মূল ষড়যন্ত্রকারী আরও কয়েকজনকে অভিযুক্ত করে একটি সম্পূরক চার্জশিট আদালতে জমা দেয়া হয়। এতে অভিযুক্ত হিসেবে আরও অন্তর্ভুক্ত হয় বিএনপির তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর মহাসচিবসহ ৩০ জন। ফলে আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫২জনে।

২০১১ সালের আগস্টে পলাতকদের বিরুদ্ধে আদালত দেশের জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়ার নির্দেশ প্রদান করে। তারই ভিত্তিতে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর, দীর্ঘ ১৪ বছর পরে ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ে বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান ও হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।

বোমা বা গ্রেনেড দিয়ে কাউকে নিশ্চিহ্ন করায় চেষ্টা গণতান্ত্রিক রাজনীতির ভাষা নয়। এ ধরনের অপরাজনীতিতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে না। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক ধারাকে কলুষিত করেছে। দেশবাসীর প্রত্যাশা অচিরেই গ্রেনেড হামলার অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। পলাতকদের আইনি প্রক্রিয়ায় দেশে এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।

১ ডিসেম্বর, ২০২৪ সালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিকে খালাস দেওয়ার এই রায় প্রমাণ করে সরকার বিচারব্যবস্থাকে পুরোপুরি জিম্মি করে রেখেছে।

ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স), আপিল এবং জেল আপিলের রায় অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। রায়ে তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

ড. ইউনূসের রিসেট বাটনের যথাযথ কার্যকারিতা আমরা দেখতে পেয়েছিলাম সেদিনের ঐ রায়ের মাধ্যমে। উনি আমাদের সবকিছু ভুলিয়ে দিতে চেয়েছেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ আগস্টের নারকীয় হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাকে পুরোপুরি মুছে ফেলার এই অপচেষ্টা।

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এতে কি প্রমাণিত হলো? দেশে কি ২১ আগস্টে কিছুই ঘটেনি? পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা আর্জেস গ্রেনেডগুলো কি আকাশ থেকে আওয়ামী লীগের সমাবেশস্থলে পড়েছিল? ২৪ জন মানুষের নিহত হয়েছিল, ৫০০ জন আহত হয়েছিল এমনি এমনিতেই?

সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকার পরও এই প্রহসনের রায় জাতির জন্য লজ্জার। প্রহসনের রায়ের মাধ‍্যমে মামলা থেকে বিএনপি নেতারা খালাস পেলেও এই নির্মম ঘটনায় বিএনপি- জামায়াত কখনোই ইতিহাসের দায়মুক্তি পাবে না।

মাহবুবউল আলম হানিফ
যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭৩০৩১