স্যার কিয়ার স্টারমার নতুন প্রধানমন্ত্রী
জুয়েল রাজ-
চৌঠা জুলাই যুক্তরাজ্যের জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস ফলাফলে বিজয়ী হয়েছে স্যার কিয়ার মারের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি। দীর্ঘ ১৪ বছর পর ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের চাবির মালিকানা অর্জন করল দলটি।
গণমাধ্যমগুলো এবারের নির্বাচনকে নানা নামে ভূষিত করছে, কারণ প্রত্যাশার চেয়ে ও দারুন ফলাফল অর্জন করেছে লেবার পার্টি। নানা কারণেই এবারের নির্বাচনটি ইতিহাসের পাতায় রেকর্ড হিসাবে থাকবে। সর্বোচ্চ সং খ্যক মন্ত্রী এমন কি সাবেক প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত ধরাশায়ী হয়ে গেছেন লেবার প্রার্থীদের কাছে।
৬৩০ টি আসনের মধ্যে , লেবার পার্টি ৪১২ , কনজার্ভেটিভ ১২১, লিবডেম ৭১ রিফর্ম- ৪ গ্রীন পার্টি ৪, এসএন পি ৯ , অন্যান্য ২৭ টি আসনে জয়লাভ করেছে। দুইটি আসনের ফলাফল ঘোষনা হয় নাই। সাংবিধানিক ভাবে ৩২৬ টি আসনে জয়ী হলেই যে কোন দল এককভাবে সরকার গঠন করতে উচ্ছ্বসিত জনগণের উদ্দেশে লন্ডনে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার বলেছেন, ‘পরিবর্তন এখন থেকেই শুরু হলো। আমি আনন্দিত’।
যুক্তরাজ্যে টানা ১৪ বছর পর ক্ষমতা থেকে সরে গেল কনজারভেটিভ পার্টি। পরাজয় মেনে নিয়ে বিদায় নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক ।ঋষি সুনাক বলেন, ‘লেবার পার্টি নির্বাচনে জিতেছে। আমি স্যার কিয়ার স্টারমারকে অভিনন্দন জানাতে ফোন করেছি। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে।
সংক্ষেপে স্যার কিয়ার স্টারমার –
২০১৫ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়ে ১০ বছরের মাথায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন তিনি। গণমাধ্যম ও অন্যান্য তথ্যে ১৯৬২ সালে লন্ডনে জন্ম নেয়ার কিয়ার আইনজীবী হিসেবে বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের পর রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পঞ্চাশের কোঠায় এসে প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন। যৌবনে তিনি উগ্র বাম ধারার রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন।যার জন্য বিভিন্ন বক্তৃতায় শ্রমজীবী শ্রেণির সঙ্গে তার জীবনের সম্পর্কের কথা প্রায়শই বলতে শোনা যায় । তার বাবা একটা কারখানার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক হিসাবে কাজ করতেন এবং মা ছিলেন নার্স।তার পরিবারও কট্টর লেবার পার্টির সমর্থক ছিল, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার নামে।স্কটিশ খনি শ্রমিক কিয়ের হার্ডির নাম অনুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল। লেবার পার্টির প্রথম নেতা ছিলেন কিয়ের হার্ডি।১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির স্থানীয় যুব শাখায় যোগ দিয়েছিলেন কিয়ের স্টারমার। কিছু সময়ের জন্য উগ্র বামপন্থী একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন।স্যার কিয়ের তার পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি শিক্ষা লাভ করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন। লিডস এবং অক্সফোর্ডে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ব্যারিস্টার হিসাবে মানবাধিকার নিয়ে কাজও করেছেন।সেই সময় ক্যারিবিয়ান এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তির জন্য তিনি কাজ করেন।১৯৯০-এর দশকে একটা বিখ্যাত মামলায়, তিনি দু’জন ইকো-অ্যাক্টিভিস্ট বা পরিবেশ আন্দোলনকারীর প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন যাদের বিরুদ্ধে ‘ম্যাকডোনাল্ডস’ মামলা করেছিল।২০০৮ সালে, স্যার কিয়ের পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টর এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। যার অর্থ, তিনি ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসের সবচেয়ে সিনিয়র প্রসিকিউটর সরকারি কৌঁসুলি ছিলেন।২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন। ২০১৪ সালে তাকে নাইট উপাধি দেওয়া হয়েছিল।
এই নির্বাচন যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারএকটি. মন্ত্রিসভার সর্বোচ্চ সংখ্যক মন্ত্রী তাদের আসন হারিয়েছেন। টানা ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে এমন বিপুল বিক্রমে ফিরে এসেছে দলটি। শেষ ১৯৯২ সালে ও ১৯৯৭ সালে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিল লেবার পার্টি। লেবারের ইতিহাসে ১৯৯৭ সালে , টনি ব্লেয়ার প্রথম ভুমিধস বিজয় অর্জন করেছিলেন – কিন্তু স্টারমারের লেবার পার্টি ৪১২ টি আসনে জয়ী হয়েভহে তিনি ব্লেয়ারের যুদ্ধ-পরবর্তী ১৭৯ টি বেশী রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন।
আর কনজারভেটিভরা এক শতাব্দীর মধ্যে তাদের সবচেয়ে খারাপ পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে। ১৯০৬ সালে তারা যে ১৫৬ টি আসন অর্জন করেছিল এবার তার চেয়ে কম মাত্র ১২১ টি আসনে জিতেছে। এত বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও, লেবার তাদের ভোটের ভাগ খুব কমই বাড়িয়েছে. পরিবর্তে, দেশের ভোট বিভিন্ন ছোত রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হয়েছে।লিব ডেমস সর্বোচ্চ ৭১ টি আসনে জয়লাভ করেছে যা তাদের ২০০৫ সালের সর্বোচ্চ ৬২টি আসনের চেয়েও বেশি।
বর্তমান ফলাফলের উপর ভিত্তি করে, রক্ষণশীল এবং লেবার পারেটির সম্মিলিত ভোট শেয়ার হল ৫৭.৭% যা রেকর্ডে সর্বনিম্ন. এটি ব্রিটিশ রাজনীতিতে ছোট দলগুলোর উত্থানের প্রমাণ যা এই নির্বাচনে সামনে এসেছে.
রিফর্ম পার্টি প্রথম তাদের চারটি আসন পেয়েছে এবং হাউস অফ কমন্সে তাদের প্রথমবারের মতো প্রতিনিধিত্ব করবে। গ্রিনস পার্টি একটি অভূতপূর্ব ভাবে ৪ টি আসনও জিতেছে, এর আগে মাত্র একটি আসন ছিল তাদের।
লেবার এখন স্কটল্যান্ডের বৃহত্তম দল, এক দশকের স্থানীয় এসএনপিত্র আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে আবার ফিরে এসেছে. বাংলাদেশের সিলেট ১ আসনের বিজয়ীর মত এটি একটি বহুল প্রচলিত ধারণা অব্যাহত রয়েছে যে লেবার স্কটল্যান্ডকে জয়ী না করে কখনোই সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়নি। ইংল্যান্ডের উত্তর-পূর্বে শুধুমাত্র একটি রক্ষণশীল আসন অবশিষ্ট আছে। এই অঞ্চলটি জনসনের অধীনে তাদের বিজয়ের প্রতীক ছিল এবং এখন আবার লাল সাগর। মানে লেবার এর বিজয় লাল পতাকা উড়ছে সেখানে। কনজারভেটিভরা ওয়েলসে তাদের সবকটি আসন হারিয়েছে এবং অক্সফোর্ডশায়ারে যেখানে লর্ড ক্যামেরন প্রতিনিধিত্ব করতেন সেখানে তাদের কোনো এমপি নেই. তারা কর্নওয়ালেও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।চার বছর আগে ২০১৯ সালে, বরিস জনসন কনজারভেটিভ পার্টিকে ৮০ সিটের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নেতৃত্ব দিয়েছিমার্গারেট থ্যাচারের পর এটাই ছিল তাদের সেরা ফলাফল বিপরীতে, ঋষি সুনাক তাদের সবচেয়ে খারাপ পরাজয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন।
১৯৩৫ সালের পর লেবার সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল. আজ সকালে দেশ তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম জয়ের জন্য জেগে উঠছে।
ব্রিটেনের ইতিহাসে লিজ ট্রাস দ্বিতীয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী যিনি সাধারণ নির্বাচনে তাঁর আসন হারিয়েছেন। ১২ জন প্রাক্তন সাংসদ রয়েছেন যারা মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন যখন ঋষি সুনাক আশ্চর্যজনক নির্বাচনের ডাক দিয়েছিলেন । ইতিহাসে এটিই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মন্ত্রিসভার সদস্যের ফেল করার ঘটনা। যাদের মধ্যে রয়েছে জ্যাকব রিস-মগ, প্রাক্তন ব্রেক্সিট মন্ত্রী এবং পেনি মুরডান্ট একসময়ের আশাবাদী টোরি নেতা, যিনি উভয়েই লেবারদের কাছে হেরেছেন গিলিয়ান কিগান, যিনি শিক্ষা সচিব ছিলেন, লিবারেল ডেমোক্র্যাট এর কাছে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।
লেবার দলের অত্যাশ্চর্য নির্বাচনে জয়ের পর বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী ডাউনিং স্ট্রিট থেকে পদত্যাগের ভাষণ দেওয়ার সময় ঋষি সুনাক জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। এবং সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে, মিঃ সুনাকও ঘোষণা করেছেন যে তিনি কদলের নেতা হিসাবে পদত্যাগ করবেন।
এবারের নির্বাচনে যুক্তরাজ্যজুড়ে ৪০ হাজার ভোট কেন্দ্রে ভোটারেরা ভোট দেন। মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৬০ লাখ। নিবন্ধিত ৯৮টি রাজনৈতিক দলের মনোনীত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ রেকর্ড ৪ হাজার ৫২৫ জন প্রার্থী এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। ভোটের লড়াইয়ে রয়েছেন লেবার পার্টির আট জনসহ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৩৪ প্রার্থীও।