লেখক: এডভোকেট পাপ্পু সাহা-

বড়ু চন্ডীদাসের “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন” বা মাইকেল মধুসূদন দত্তের “মেঘনাদবধ” সনাতনীদের কোনো গ্রন্থ নয়। আমরা জানবো “গীতা”র শ্রীকৃষ্ণকে, আমরা জানবো “মহাভারত” এর শ্রীকৃষ্ণকে। জানতে হবে “রামায়ণ” এর শ্রীরামকে। মূলত বিদেশী শাসকরা মহাভারতকে বিকৃত করার জন্যই তাদের সভাকবি বড়ু চন্ডীদাসকে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তণ নামক ফরমেয়াশী বইটি লেখায়। এই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়লে বুঝা যায়, শ্রীকৃষ্ণের প্রেম করা আর বাঁশি বাজানো ছাড়া অন্য কোন কাজ নাই। আমরা ঘৃণাভরে এই বিকৃত কাব্য প্রত্যাখ্যান করছি। মেঘনাদবধের বিষয়ে পরবর্তীতে লিখব, আজ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন সম্পর্কে লিখছি।
প্রায় ৮০০ বছর বাংলাসহ ভারতবর্ষকে বিভিন্ন উপনিবেশীকবাদরা শাসন-শোষণ করেছিল। এই শাসকরা তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য ধর্মান্তরকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ভারতবর্ষের মানুষের ভক্তিবাদের গভীরতা এতই প্রবল ছিল যে, তাদের এই চেষ্টা অনেকটাই ব্যর্থ হয়। অত্যাচার, প্রলোভন ও সনাতনীদের ঘৃণ্য জাত প্রথার কারণে কিছু সংখ্যক মানুষকে তারা ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য যে ‘ মৌর্য’ সাম্রাজ্য পর্যন্ত সনাতনীদের মধ্যে কর্মের বিভাজন ছিল, কিন্তু জন্ম বা বর্ণের বিভাজন ছিল না। কিন্তু মধ্যযুগে আমাদের কর্মের বিভাজন রূপ নেয় জন্মের বিভাজনে অর্থাৎ জাত-পাত নামক ব্যাধি ভয়ংকররূপ ধারণ করে। শুধু তাই নয়, এই বিদেশী শাসকরা তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার জন্য আমাদের মধ্যে কিছু ব্লু-ব্লাড বা দালাল শ্রেণীর ( রায়,বাহাদুর,চৌধুরী, মহাজন,জমিদার ইত্যাদি) সৃষ্টি করে আমাদেরকে খন্ড-বিখন্ড করে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করে। অথচ হাস্যকর ভাবে আমাদেরই কিছু লোক এই বিদেশি শাসকদের জাস্টিফাই করে তারা নাকি আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি শিখিয়েছেন। তাদের নিকট আমি নিবেদন করতে চাই – পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থানে যখন বিভিন্ন জাতির অক্ষর জ্ঞানও ছিলনা, তখনও ভারতবর্ষে নালন্দা,তক্ষশীলা,বিক্রমশীলা,ওদন্তপুরি, ভল্লবীসহ অনেক আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। বখতিয়ার খিলজী সেই আমলের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় ‘নালন্দা’ ধ্বংস করে।একই সময়ের ইতিহাসবিদ ইরানের ফারসি কবি মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ তার “তাবাকাত-ই-নাসিরী” গ্রন্থে এর পূর্ণ বিবরণ দেন। নালন্দার লাইব্রেরির ৯০ লক্ষ পাণ্ডুলিপি ধ্বংস করা হয়, যার আগুন প্রায় তিন মাস পর্যন্ত জ্বলেছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ১০,০০০ শিক্ষার্থীর জন্য ২০০০ শিক্ষক শিক্ষাদান করতেন।বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র হলেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায়শাস্ত্র, চিকিৎসার্বিদ্যা, শরীরতত্ত্ব,সংগীত,চিত্রকলা, যোগ,ব্যাকরণ,যুক্তিবিদ্যা, গনিত,জ্যোর্তির্বিদ্যা,দর্শণ,শব্দবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হতো।
বিদেশিরা যখন লক্ষ্য করলো, ভারতবর্ষের মানুষের ভক্তিবাদের মূল কেন্দ্রে রয়েছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তখনই তারা শ্রীকৃষ্ণকে অপ্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বহীন করার কাজে লিপ্ত হয়।এতে কুশীলব হিসাবে ব্যাবহৃত হয় তখনকার চরম লোভী সভা কবিরা। এই ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে, কলিকাতার তথাকথিত রত্ন সেকু- মাকু বাবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে উপস্থাপন করেন মা কালী হচ্ছেন ‘সাঁওতালি মাগী’ এবং ‘অর্ধজীবন’ উপন্যাসে উল্লেখ করেন মা সরস্বতীকে দেখলে নাকি উনার যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, ছোটবেলায় নাকি উনি মা সরস্বতীর ঠোঁটে চুমু খেয়েছেন এবং তার বুকে হাত দিয়েছেন। দুর্ভাগ্য, এই বেজন্মা ও ভাদাইম্যাগুলোকে হিন্দুরাই প্রমোট করেছে ।শুধু তাই নয় তখনকার, শিল্প সাহিত্যে বহু মুখরোচক গাল-গল্প, গান, পালা শ্রীকৃষ্ণের নামে চালিয়ে দেয়া হয়। বোকা হিন্দুরা না বুঝে এই অখাদ্য অনবরত গিলতে থাকে।
তবে খুব আশ্চর্যের বিষয় উপনিবেশীবাদের প্রভাবে দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকা,মধ্য এশিয়া, পূর্ব এশিয়াসহ বেশিরভাগ এলাকায় ১০০ থেকে ২০০ বছরের ব্যবধানেই পুরো জনবিন্যাস পরিবর্তন হয়ে গেছে। কিন্তু ভারতবর্ষে ৮০০ বছরের পরেও ভারতবর্ষের কৃষ্টি-কালচার ও সংস্কৃতি স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে।
এবার জানবো গীতা বা মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণকে। শ্রীকৃষ্ণ শিশুকালে তার মা যশোদাকে এবং কুরুক্ষেত্রে তার প্রিয় সখা অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন, কংসকে বধ করে পিতা মাতাকে কারামুক্ত করেছেন, উগ্র সেনকে তার রাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছেন, আদর্শ নগরী দ্বারকা প্রতিষ্ঠা করেছেন, কুরুক্ষেত্রে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন, আমাদেরকে গীতার জ্ঞান দিয়েছেন, ওঁ-কারকে নিরাকার ব্রহ্মের শব্দরূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিরাকার ও সাকার উপাসনার তাৎপর্য শিখিয়েছেন, দ্রৌপদীর সম্মান রক্ষা করেছেন, নরকাসুরের হাত থেকে ১৪ হাজার নারীকে রক্ষা করেছেন, জরাস্বন্ধের হাত থেকে রাজসূয় যজ্ঞের নামে হত্যার হাত থেকে ১০১ জন রাজার জীবন বাঁচিয়েছেন, পুতোনা রাক্ষসী, অগাসুর-বকাসুরকে বধ করেছেন,কালীয় দমন করেছেন, গোবর্ধন পর্বতকে আঙ্গুলে ধারণ করেছেন, গোমাতার মাহাত্ম্য শিখিয়েছেন, রাজা হওয়ার পরও বাল্যবন্ধু সুদামার পা ধুয়ে দিয়েছেন এভাবে সব ১০০ পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবেনা। অথচ বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পড়লে বুঝা যায় শ্রীকৃষ্ণ শুধু ননী খায়, বাঁশি বাজায় আর প্রেম করে।
মূলত ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ১১ বছর বয়সে বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরা চলে যান, সেখানে কংসকে বধ করে পিতা-মাতাকে উদ্ধার করার পরে শ্রীকৃষ্ণকে তার পিতা-মাতা অধ্যয়নের জন্য গুরুগৃহ তথা সন্দীপন মুনির আশ্রমে পাঠিয়ে দেন, সেখানে তিনি ২৫ বছর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং জীবনে আর কোনদিন বৃন্দাবন ফিরে যাননি। তাই বৃন্দাবনের সখীলীলা বা অন্য সব গাল-গল্প এগুলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে আরম্ভ হয়ে তা আরো ঢালপালা মেলতে থাকে। রসবোধ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে যৌন সুড়সুড়ির জন্যও এসব অখাদ্য সনাতনীরা গিলতে থাকে।
অথচ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের কর্ম, কর্মফল, ভক্তি, জ্ঞান, আত্মা, জন্মান্তর,আহার, ,ধর্মযুদ্ধ, আদর্শ রাষ্ট্র, আদর্শ শাসনব্যবস্থা,মৌক্ষলাভের উপায় সবই দিয়ে গেছেন।আজকে সেকু-মাকুরা সনাতনীদের সাম্যবাদের ছবক শেখায়। অথচ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় আত্মা সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ অর্থাৎ পরমাত্মা হচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণরুপি ঈশ্বর, আত্মা হচ্ছে জীবাত্মা। অন্যভাবে বলা যায় প্রত্যেক জীবের মধ্যে ঈশ্বর আত্মা রূপে বিরাজ করেন। যাকে এক কথায় বলা যায় জীবের সেবা করা মানেই ঈশ্বরের সেবা করা। এই থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- “বহুরূপী সম্মুখে তোমার কোথায় খুঁজিছ ঈশ্বর, জীব প্রেম করে যে জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর “। এর থেকে মানবিক বা লেটেস্ট দর্শন আর কি হতে পারে। বিভিন্ন অপসংস্কৃতির ফলে যখন আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ থেকে বিচ্যুত হতে যাচ্ছিলাম বা ভুলতে বসেছিলাম তখনই আমাদের এই ভক্তিবাদের দর্শনকে আবার জাগ্রত করেন শ্রীমন মহাপ্রভু (শ্রীচেতন্য) এই প্রসঙ্গে পরে আরেকদিন লিখব।
তাই সবশেষে বলবো, আমাদের শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ, গীতার শ্রীকৃষ্ণ। মহাভারতের মূল উপজীব্য নারীকে সম্মান করো অথবা ধ্বংস হও। শুধু একজন নারী দ্রৌপদীর অসম্মানের জন্যই কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, ইহায় হচ্ছে মহাভারতের মূল শিক্ষা। ঈশ্বর আমাদের সবার মঙ্গল করুন। সবাইকে পবিত্র জন্মাষ্টমীর শুভেচ্ছা।