২১ আগস্টের রক্তাক্ত অধ্যায়, শহিদদের ঋণ ও আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

 

এফএম শাহীন-

বাংলাদেশের ইতিহাস যতবারই লেখা হবে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেখানে থাকবে এক কালো দিন হিসেবে। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগ সমাবেশের মঞ্চে কয়েকটি মিলিটারি-গ্রেডের গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়েছিলো, যার লক্ষ্য ছিল স্পষ্ট ও নির্মম—শেখ হাসিনাকে হত্যা করে একটি দল ও একটি আদর্শকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া। সেদিনের সেই ভয়াল বিকেলে মানুষের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়েছিল, রক্তে ভেসে গিয়েছিল রাজপথ।

হামলায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ২৪ জন নেতাকর্মী শহিদ হন। আহত হন ৩ শতাধিক মানুষ, যাদের অধিকাংশই আজও পঙ্গুত্ব বা শারীরিক কষ্ট নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী আইভি রহমান, যার মৃত্যু গোটা জাতিকে শোকসাগরে ডুবিয়ে দেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেঁচে যান অলৌকিকভাবে, কিন্তু তাঁর শ্রবণশক্তি আজও সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের ক্ষত বহন করছে।

২১ আগস্ট কেবল একটি জঙ্গি হামলা ছিল না; এটি ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের সক্রিয় মদদপুষ্ট সন্ত্রাস। পরিকল্পনাটি করেছিল হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নামের জঙ্গি সংগঠন, কিন্তু এর পেছনে ছিল বিএনপি-জামায়াতের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

পরবর্তীতে বিচার প্রক্রিয়ায় প্রমাণিত হয়েছে—এই হামলার সাথে যুক্ত ছিলেন বিএনপি’র তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপ-শিক্ষামন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জামায়াতে ইসলামের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিস চৌধুরী, এমনকি গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ও এনএসআই-এর শীর্ষ কর্মকর্তারাও। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকেও মদদ এসেছিল। কাশ্মিরি হিজবুল মুজাহিদিন, তেহরিক জিহাদ-ই ইসলাম, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং মিয়ানমার ভিত্তিক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)সহ বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠী এতে যুক্ত ছিল। ২১ আগস্ট ছিল রাষ্ট্রযন্ত্র, দেশি-বিদেশি জঙ্গি গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক চক্রের সমন্বিত এক হত্যাযজ্ঞ, যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মাটিতে সংঘটিত সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলা।

এই ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচারকাজ বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। হামলার মূল পরিকল্পনাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু এখানেই প্রশ্ন থেকে যায়—আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দায় কোথায়? কারণ আওয়ামী লীগ ২০০৯ থেকে টানা ১৬ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও এই রায় কার্যকর করার প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। শহিদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা ভোগ করেছে, উন্নয়ন আর সমৃদ্ধির ভাষণে দেশ ভরিয়েছে, কিন্তু নিজেদের কর্মীর রক্তের বিচারকে জাতীয় ন্যায়বিচারের শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি। ফলত, শহিদদের পরিবার বছরের পর বছর অপেক্ষায় থেকেছে, আর দলীয় রাজনীতির মঞ্চে শহিদদের নাম উচ্চারিত হয়েছে কেবল ফুল-মালা আর বক্তৃতার অলঙ্কার হিসেবে। আওয়ামী লীগের বড় ব্যর্থতা হলো—তারা নিজেদের শহিদদের রক্তের ঋণ যথাযথভাবে শোধ করতে পারেনি।

আমরা দেখতে পেলাম আওয়ামী লীগের ভেতর প্রবেশ করেছে সুযোগসন্ধানী, আদর্শহীন, ক্ষমতালোভী মানুষ। শহিদ নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ ভুলে দল ক্রমে রূপ নিয়েছে ক্ষমতাসীন আমলাতন্ত্রে। শহিদের পরিবারের কান্না ঢেকে গেছে নেতাদের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সভা-সেমিনারের বক্তৃতায়। শহিদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতা ভোগ করা, এটাই আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় নৈতিক ব্যর্থতা।

এই ব্যর্থতা শেষ পর্যন্ত ইতিহাসকে প্রতিশোধ নিতে বাধ্য করেছে। শহিদের রক্তের ঋণ শোধ না করার ফল, জামায়াত-বিএনপি চক্রকে পুরোপুরি বিচারের মুখোমুখি না করার ফল, আর ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে ন্যায়বিচারকে গৌণ করার ফল আমরা দেখেছি ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। সেদিন শেখ হাসিনাকে উৎখাত করা হলো ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে, আর বাংলাদেশ নিক্ষিপ্ত হলো অরাজকতার গভীর খাদে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে ওঠা রাষ্ট্র একদিনে পরিণত হলো মব সন্ত্রাসের নরকে। নির্মমভাবে পুলিশ হত্যা, রাজনৈতিক কর্মীদের হত্যা, মসজিদ-মন্দির, রাস্তায় রক্ত, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নারী নিপীড়ন, অগ্নিসংযোগ আর গণহত্যা—যা কেবল ক্ষমতার রাজনীতির বিচারহীনতার পরিণতিই প্রকাশ করেছে।

২১ আগস্ট কেবল একটি সন্ত্রাসী হামলা নয়, এটি ছিল জাতিকে নেতৃত্ব শূণ‍্য করার ষড়যন্ত্র। সেই হামলার বিচার আংশিকভাবে সম্পন্ন হলেও আওয়ামী লীগ নিজেদের রাজনৈতিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। শহিদের রক্তের ঋণ ভুলে গিয়ে তারা ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়েছে, আর এই ব্যর্থতার ফলেই ষড়যন্ত্রকারীরা নতুন করে সুযোগ পেয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ আজ এই অন্ধকার থেকে নতুন আলোর পথ খুঁজছে। কিন্তু শিক্ষা একটাই—যে দল শহিদের রক্ত ভুলে যায়, সে দল ইতিহাসের আঘাত থেকে রক্ষা পায় না। তাদেরকেও কঠিন মূল‍্য চুকাতে হয়।

— এফ এম শাহীন, ২১ আগস্ট, ২০২৫
চলচ্চিত্র নির্মাতা, সংগঠক ও গণমাধ্যমকর্মী

Share on facebook
Share on twitter
Share on linkedin

আরো পড়ুন

সর্বশেষ খবর

পুরাতন খবর

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১